‘নিজেদের কন্ডিশনে’ স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা

নিউ জিল্যান্ডে ক্রিকেট ম্যাচে একটা চমৎকার রীতি আছে। ম্যাচ শেষে ক্রিকেটাররা গ্যালারির পাশে যান দর্শকদের কাছে। সেলফির গ্রাসে বাংলাদেশে অটোগ্রাফ হারিয়ে গেলেও এখানে সেটির আবেদন এখনও আছে। ব্যাট, বল, ক্যাপ, জার্সি, ডায়েরিতে প্রিয় তারকার অটোগ্রাফ নেয় শিশু-কিশোর-তরুণরা। স্বপ্নের তারকাকে কাছে পেয়ে তাদের চোখে-মুখে রোমাঞ্চের সে কী ঝিলিক!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিনেলসন থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2016, 11:39 AM
Updated : 29 Dec 2016, 11:51 AM

স্যাক্সটন ওভালে ম্যাচ শেষে এভাবেই এক প্রান্তে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন কিউই ক্রিকেটাররা। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে চন্দিকা হাথুরুসিংহে, থিলান সামারাবিরা, কোর্টনি ওয়ালশ ও রিচার্ড হ্যালসল। মনে হচ্ছিলো, মাঠেই কোনো জরুরি মিটিং করে ফেলছে বাংলাদেশের গোটা কোচিং স্টাফ। হতাশার হারের পর আলোচনার বিষয়বস্তু অনুমান করে নিতে অসুবিধা হয় না!

ড্রেসিং রুমের থমথমে পরিবেশটাও অনুমেয় সহজেই। সেখান থেকে একটু পর বেরিয়ে এলেন তামিম ইকবাল। টুকটাক কথার এক পর্যায়ে কণ্ঠে তার আক্ষেপের সুর, “কী দারুণ উইকেট ছিল, কী সুযোগটাই না মিস করলাম…!”

দারুণ উইকেট আর সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া, ঘুরে ফিরে এই দুই কথাই দল সংশ্লিষ্ট সবার কণ্ঠে। নিউ জিল্যান্ডের মাটিতে তাদেরকে প্রথমবার হারানোর আদর্শ ক্ষেত্র ছিল প্রস্তুত। ভেস্তে গেছে ব্যাটসম্যানদের খামখেয়ালিপনা আর দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিংয়ে।

ক্রাইস্টচার্চে বড় বাধা ছিল সেখানকার ঠাণ্ডা ও বাতাস। নেলসনে এই সমস্যা নেই। সকালে আকাশ মেঘলা থাকলেও রোদ উঠেছে দ্রুতই। আবহাওয়া অনেকটা ছিল বাংলাদেশের মতোই।

দেশের মতো ছিল উইকেটও! নেলসনের উইকেট বরাবরই ব্যাটিং সহায়ক। তবে নিউ জিল্যান্ডের গতি ও বাউন্স তো কিছুটা থাকেই। অথচ এদিন সব সময়ের চেয়ে উইকেট ছিল সামান্য মন্থর, যেটি প্রায় বাংলাদেশের মতোই!

প্রয়োজন ছিল পরিচিত কন্ডিশনে চেনা পারফরম্যান্স। কিন্তু স্বস্তির আবহেও ব্যাটিং হলো আত্মঘাতী। ম্যাচ শেষে মাশরাফি বিন মুর্তজার কণ্ঠে ফুটে উঠল সেই হতাশা।

“প্রথম ইনিংস শেষে আমরা খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। জানতাম দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেট আরও সহজ হয়ে উঠবে ব্যাটিংয়ের জন্য। সেটাই হয়েছে। গত ম্যাচে ব্যাটিং উইকেট থাকলেও বোল্ট কিছুটা সুইং পেয়েছিল। আজকে একটুও সুইং পায়নি।”

“বোল্টরা যখন সুইং পায় না, তখন মনে করতে হবে এটা প্রায় আমাদের কন্ডিশনের মতোই। নিউ জিল্যান্ডের ৫-৬ ওভার বোলিংয়ের পর যখন দেখলাম সুইং পাচ্ছে না ওরা, তখন আরও বিশ্বাস বেড়েছে। ভালো ব্যাটিংই করছিলাম আমরা। এরপরই ধস নামল। খুবই হতাশাজনক।”

তামিম ইকবাল বারবার বলছিলেন, প্রথম ম্যাচের চেয়ে এই ম্যাচের উইকেট ব্যাটিংয়ের জন্য ছিল আরও ভালো। একই কথা মাশরাফির কণ্ঠেও। হতাশার মাত্রাটাও তাই বেশি।

“সত্যি কথা বলতে, উপমহাদেশের দলগুলি এখানে এলে এ রকম সুযোগ খোঁজে। আমরা পেয়েও হারালাম। আগের দিন আমরা হয়ত ৪০-৫০ রান বেশি দিয়েছিলাম, তবু সুযোগ পেয়েছিলাম। আজকে উইকেট আগের দিনের চেয়ে নিষ্প্রাণ ছিল। আমরা ভালো খেলছিলামও। ওখান থেকে এরকম ধস আশা করিনি। খুব বড় একটি সুযোগ হাতছাড়া হলো।”

তামিম আক্ষেপের কথা বলছেন, দায় নিতে হবে তাকেও। এই মাঠে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তার ৯৫ রানের ইনিংসেই বিশ্বকাপে ৩১৯ রান তাড়া করেছিল বাংলাদেশ। উইকেট এদিনও ছিল ব্যাটিং সহায়ক। লক্ষ্য অনেকটা সহজ, হাতছানি আরও বড় জয়ের। এমন দিনে সেরা ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে সেরাটাই চাইবে দল। তামিম আউট হলেন বাজে এক শটে।

ইমরুল কায়েস ও সাব্বির রহমানের ভুল বোঝাবুঝি ছিল একদম ছেলেমানুষী। এই ভুল বোঝাবুঝিতে দায় যারই থাক, নিজের আউটের দায় সাব্বিরের নিতে হবে নিজেকেই। কাছে থেকেও ক্রিজে ব্যাট ছোঁয়াতে পারেননি তিনি। দারুণ খেলছিলেন, ও সময় তার উইকেটে থাকা দলের জন্য ছিল জরুরি।

একমাত্র মাহমুদউল্লাহই আউট হয়েছেন ভালো বলে, যদিও এমন নয় যে সেই বল খেলা যেত না। লকি ফার্গুসনের গতির কারণেই হয়ত একদম জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মাহমুদউল্লাহ, আশা করছিলেন শর্ট বল। ফার্গুসন সেটা খেয়াল করেই হয়ত করেন ইয়র্কার। সেটি সামলানোর পজিশনেই ছিলেন না এই মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যান।

প্রয়োজনের সময় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ সাকিব। সম্ভব প্রায় সব ভাবে আউটের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে ইমরুল কায়েস কোথায় ম্যাচ জেতাবেন, উল্টো যে পণ করেছিলেন আউট হয়েই ছাড়বেন!

মোসাদ্দেক এখনও নবীন। কিন্তু স্পিনে তার দক্ষতার কথা মাথায় রাখলে তার শটও মেনে নেওয়ার মত নয়। অভিষিক্ত তানবীরের কাছ থেকে কী-ই বা চাওয়ার আছে! নুরুল হাসান সোহান বরং দেখিয়েছেন, মুশফিকের বিকল্প না হলেও তিনি অন্তত অবদান রাখতে পারেন।

কিন্তু সোহান পেলেন না সঙ্গ দেওয়ার মত কাউকে, না পেলেন কারও সঙ্গ। শেষ দিকে তার ও মাশরাফির ব্যাটিংয়ে বরং আরও ভারী হয়েছে দীর্ঘশ্বাস। ব্যাটসম্যানদের অন্তত একজন যদি লম্বা করতে পারতেন ইনিংস!

তবে হারটা হতাশার হলেও একদিক থেকে খুব বিস্ময়কর নয়। কন্ডিশন যেমন ছিল বাংলাদেশের মতো, দল হারলও তো নিজেদের মতোই! ৩৬ রানের মধ্যে ৬ উইকেট, ৭৯ রানে শেষ ৯ উইকেট। এমন ধস তো বাংলাদেশ ক্রিকেটের খুব চেনা! ধসটা যখন নামে, শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর কেউ থাকে না। সবার অবস্থা তখন যেন, “কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন বনে যাই…।”

বনে না গেলেও মনে অন্তত যেতেই হবে। সব ব্যাটসম্যানকেই যেতে হতে নিজের মনের কাছে। প্রয়োজন আত্মজিজ্ঞাসা। ধসের বশ আর কত দিন?