‘এটা ক্রিকেট নয়, সুযোগ আদায়ের যুদ্ধ’

দুবাইয়ের আইসিসি একাডেমি মাঠে প্রতিবন্ধীদের ত্রিদেশীয় ক্রিকেটে বাংলাদেশ দল যখন খেলার জন্য মাঠে লড়ছে, দর্শক সারিতে বসে বিস্ময় নিয়ে তা দেখছিলেন কয়েকজন।

সুলাইমান নিলয় দুবাই থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2016, 09:15 PM
Updated : 21 Oct 2016, 09:15 PM

শুক্রবার সকালের ভাগে বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান ম‌্যাচের সময় দর্শক সারিতে কথা হয় দুবাইয়ের কাঁচামাল ব্যবসায়ী মো. হাসানের সঙ্গে, যিনি মাঠে এসেছেন খালাতো ভাইয়ের খেলা দেখতে।

এমনিতে দর্শকদের প্রবেশাধিকার না থাকলেও ভাইয়ের খেলা বলে হাসান ঢোকার সুযোগ পেয়েছেন। খেলা দেখার সময়ও হাসানের বিশ্বাস হচ্ছিল না, তার ভাই খেলতে দুবাই এসেছে, আর তিনি সেই খেলা দেখছেন।

হাসানের ভাই জাভেদ বাংলাদেশের শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান। তার সম্পর্কে দলে প্রচলিত কথা হচ্ছে, ব্যাটিংয়ে জাভেদের টিকে থাকা মানেই রান।

হাসান বলেন, “জাভেদ আসার আগে ফোন করেছিল, আমি বিশ্বাস করিনি। বিমানের ওঠার আগেও ফোন করেছে। আমার কাছে কেমন কেমন মনে হয়েছে। এখন দেখি, ও ঠিকই এসেছে।”

চট্টগ্রামের বাসিন্দা হাসানের সঙ্গে আসা একই এলাকার মীর মঞ্জু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাশের দুবাই স্টেডিয়ামে একবার খেলা দেখতে এসেও টিকেট পাননি। আর আইসিসির এই মাঠে আসতে পারবেন, তা কখনো ভাবেননি।

ব্যবস্থাপনা সেবাদানকারী একটি আউট সোর্সিং কোম্পানির হয়ে আইসিসি একাডেমিতে নিয়োগ পাওয়া শরিফ আহমেদ বাংলা ভাষাভাষীদের আড্ডা দেখে এগিয়ে আসেন।

তিনি জানান, এই মাঠে দর্শক আসতে পারে না। টিকেটের কোনো ব‌্যবস্থা নাই। সাধারণত এখানে প্রাকটিস ম্যাচ হয়। খেলা হলেও দর্শক থাকে না।

কিছুক্ষণ পর মাঠে এলেন ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের ডিজেবিলিটি ক্রিকেটের প্রধান ইয়ান মার্টিন, যিনি ১৯৯৯ সাল থেকে প্রতিবন্ধীদের ক্রিকেট নিয়ে কাজ করছেন। ২০১০ সালে তাকে বোর্ডের ডিজেবিলিটি ক্রিকেটের প্রধান করে দেওয়া হয়।

ইয়ান মার্টিন বলেন, জীবনের অন্য সব সুযোগের মত প্রতিবন্ধী মানুষের খেলার অধিকারও থাকা উচিত।

“প্রতিবন্ধিতা কোনো বিষয় না। তুমি চাইলেই সামনে আসতে পার, খেলতেও পার। এজন্য আমাদের আরো কাজ করতে হবে। এখনকার সুযোগ বাড়াতে হবে।”

তিনি বলেন, “২০০৪-০৫ সালের দিকে স্বপ্ন দেখতাম, প্রতিবন্ধীদের আন্তর্জাতিক ম্যাচ হবে। সেটা সত্য হয়েছে। ২০১৯ সালে এদের নিয়ে বিশ্বকাপ করতে চাই। আমাদের ক্রিকেট বোর্ডে সেটা পাসও হয়েছে।”

আন্তর্জাতিক ম্যাচ আর বিশ্বাকাপের এই স্বপ্ন ছড়িয়েছে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মাঝেও, জাভেদ যাদের একজন।

নিজের জেলা গোপালগঞ্জে অনুর্ধ্ব ১৬ দলে সুযোগ পেলেও পরে বাদ পড়ে যান অনুর্ধ্ব- ১৮ তে। এরপর মূলধারার ক্রিকেট ছেড়ে দেন তিনি। ২০১৬ সালের ট্যালেন্ট হান্টে সুযোগ পেয়ে যান প্রতিবন্ধী ক্রিকেটের জাতীয় দলে। এখন তার স্বপ্নজুড়ে কেবলই দল।

জাভেদদের এই দলকে যারা সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে, সেই আন্তর্জাতিক রেডক্রসের (আইসিআরসি) ফিজিক্যাল রিহ্যাবিলিটেশন প্রকল্পের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, এই ক্রিকেট এদের জীবনের বিশ্বাস বাড়িয়ে দিচ্ছে।

“বাংলাদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার কারণেই প্রতিবন্ধী মানুষদের মাঝে বিশ্বাস ছড়াতে ক্রিকেটকে আমরা বেছে নিয়েছি।”

তিনি বলেন, ‍“মনে করেন, ডিজেবল মানুষ, যাদের একটা হাত নাই, সেটা লুকায়ে রাখে। এদের সেটা লুকায়ে রাখার দরকার নেই। কারণ একটা হাত না থাকলেও আমি মাশরাফির মতো বল করতে পারি।

“এই খেলার খবরের জন্য প্রতিবন্ধী কমিউনিটি প্রতীক্ষায় আছে। তারা সংবাদ মাধ্যমে আসে না। কোথাও ইতিবাচকভাবে তাদেরকে তুলে ধরা হয় না।”

দুবাইয়ের প্রতিযোগিতায় প্রথম তিন ম্যাচে বাংলাদেশ হারলেও এই ক্রিকেট মাঠে খেলে যাওয়ায় খুশি মাহফুজুর।

“এখনকার জেতা-হারা বিষয় নয়। দীর্ঘমেয়াদী ফলটা দেখতে হবে।”

শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে প্রথমবারের মতো গত বছর ঢাকায় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের আসর বসে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) আয়োজনে। টুর্নামেন্টে স্বাগতিক বাংলাদেশ, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান ছাড়াও অংশ নেয় ভারত ও আফগানিস্তান।

ওই প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড। সেই আয়োজন বাংলাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

সফল সেই আয়োজনে সুখস্মৃতি থেকেই দুবাইয়ে এ টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল। আর বাংলাদেশ দলকে এবারও সহযোগিতা দিচ্ছে আইসিআরসি।