বিন্দু বিন্দু ঘামে কেনা মাশরাফির সাফল্য

মাসখানেক আগের ঘটনা। তাল পাকা গরম কেন বলা হয়, ভাদ্র মাসের প্রকৃতি সেটা জানান দিচ্ছিল তীব্রভাবেই। জাতীয় দলের ক্যাম্পে তখন ঈদুল আজহার ছুটি। তবু শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে দেখা গেল গা পুড়ে যাওয়া রোদে রানিং করে চলেছেন একজন। একটু কাছে যেতেই স্পষ্ট হলো অবয়ব। মাশরাফি বিন মুর্তজা!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Oct 2016, 06:31 AM
Updated : 10 Oct 2016, 12:15 PM

এমনিতে জিমনেসিয়ামের সঙ্গে মাশরাফির আজীবনের গাঁটছড়া লেখা হয়ে গেছে বেশ আগেই। বারবার ছুরি-কাঁচির খোঁচায় মানচিত্র বদলে যাওয়া দুই হাঁটু আর আরও ছোটখাটো অসংখ্য চোটের ধকল সামলানো পা দুটোকে সচল রাখতে খেলা ছাড়ার পরও তাকে নিয়মিত জিম করে যেতে হবে। কিন্তু এটা তো জিমনেসিয়ামের শীতল বাতাসে কসরত নয়, প্রখর রোদে ঘাম ঝরানো। সেটাও যখন ঈদের ছুটি হয়ে গেছে দুদিন আগেই!

ঘামে জবজবে শরীরে পানির বোতল হাতে খানিক পর মাঠের বাইরে এলেন অধিনায়ক। যথারীতি ঠাট্টা, মজা, খুনসুটির ফাঁকে একটু সিরিয়াস হয়ে বললেন, “এই রোদে দাঁড়ানোই মুশকিল, রানিং তো আরও কষ্টের। তবু করলাম। হয়ত একটু বেশি ঘাম ঝরালে একটা উইকেট বেশি পাব!”

মাশরাফিকে নিয়ে বিস্ময়ের বিশেষত্ব হারিয়েছে অনেক আগেই। তবু আরও একবার নতুন করে অবাক হওয়ার পালা। বাংলাদেশ দলের ওয়ানডে অধিনায়ক, দলের ভেতরে বাইরে সবার প্রিয় নেতা, বল হাতেও যিনি সেরাদের একজন, ৩৩ বছর বয়সে তিনি এভাবে ঘাম ঝরিয়ে যাচ্ছেন আরেকটু ভালো করার আশায়!

অবাক চাহনিটা দেখেই হয়ত আবার হাসলেন মাশরাফি, “নিজের কাছে কিন্তু আমার ছুটি নেই। বিশ্বাস করবেন কিনা, ঈদের দিন ভোরে উঠেও আমি আগে রানিং করে নেই। এরপর ফিরে ফ্রেশ হয়ে নামাজে যাই।”

এই হলেন মাশরাফি। লোকে তাকে ভাবেন রূপকথার চরিত্র। রক্তমাংসের মানুষের চেয়েও বেশি কিছু। অনেকের কাছে, মানুষের সীমাহীন সামর্থ্যের উজ্জ্বল উদাহরণ। আদতে মাশরাফির গল্পটা কঠোর পরিশ্রমের, নিজেকে নিত্য ছাড়িয়ে যাওয়ার লড়াইয়ের। রণাঙ্গনে আরেকটু ভালো করার জন্য ট্রেনিংয়ে আরও জোর দেওয়া, আগেরবারের চেয়ে একটু বেশি! অবিশ্বাস্য শৃঙ্খলা, রক্ত জল করা খাটুনি, আর বিন্দু বিন্দু ঘামে কেনা মাশরাফির সাফল্য!

ব্যাট হাতে ঝড়ো ৪৪, বল হাতে অসাধারণ এক প্রথম স্পেল আর শেষের পেরেকটা ঠোকা, মাশরাফির অসাধারণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে দ্বিতীয় ওয়ানডে জিতে বাংলাদেশ। ম্যাচ সেরায় ছিল না তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী। অনেকের মনে প্রশ্ন, কত দিন পর ম্যাচ সেরা হলেন মাশরাফি?

২০১৪ সালের নভেম্বরের পর। এই দফায় নেতৃত্ব পাওয়ার পর দ্বিতীয় ম্যাচেই ম্যান অব দা ম্যাচ হয়েছিলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩ উইকেট নিয়ে। খোলা চোখে দেখলে, অনেকটা সময় আর বেশ কিছু ম্যাচে সেরা হতে পারেননি তিনি। কিন্তু একটু গভীরে গেলেই দেখা যাবে, এই দফায় অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর বাংলাদেশের সেরা পেসার এবং দ্বিতীয় সেরা বোলার মাশরাফিই। এই সময়টায় সাকিব আল হাসানের (৪৪) পর সবচেয়ে বেশি উইকেট মাশরাফিরই (৪০)!

২৯ রানে ৪ উইকেট পেয়েছেন মাশরাফি। মুহূর্তেই বেরিয়ে এল পরিসংখ্যান, ওয়ানডেতে সবশেষ ৪ উইকেট পেয়েছিলেন ঠিক ৮ বছর আগে আরেকটি ৯ অক্টোবর নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে। এত বছর পর ৪ উইকেট! একটু বিশদ খুঁজলে দেখা যাবে, এই ৮ বছরে যথারীতি বাংলাদেশের সেরা পেসার এবং দ্বিতীয় সেরা বোলার মাশরাফিই। এই সময়টায় সাকিবের (১৬৪) পরই সবচেয়ে বেশি উইকেট মাশরাফির (রাজ্জাকের সঙ্গে যৌথভাবে, ৯৮ উইকেট)।

এই পরিসংখ্যান দুটি প্রমাণ করছে, মাশরাফি কতটা ধারাবাহিক। শুধু অধিনায়ক নন, বোলার মাশরাফিও দলের জন্য কতটা অপরিহার্য। ম্যাচ সেরার পুরস্কার তো স্রেফ ২-১টা মাচের স্বীকৃত মাত্র।

পরিসংখ্যানের বাইরেও আছে অনেক কিছু। পরিসংখ্যান বলবে না, চোট জর্জর ক্যারিয়ারে গতি কমে অনেক সীমাবদ্ধতা চেপে বসলেও কিভাবে দিনের পর দিন শিকার ধরার নতুন অস্ত্র বের করেছেন মাশরাফি। মুস্তাফিজুর রহমানের কাটারে মুগ্ধ ক্রিকেট বিশ্ব, অথচ গত কয়েক বছরে কাটারেই নিজের বেশিরভাগ শিকার ধরেছেন মাশরাফি।

পরিসংখ্যানে নেই, তার নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ব্যাটসম্যানরা হাঁসফাঁস করে কতবার উইকেট দিয়েছে অন্য বোলারকে বা তার একটি-দুটি উইকেটও কতবার ঘুরিয়ে দিয়েছে ম্যাচের মোড়! পরিংসংখ্যান বলবে না, মুস্তাফিজুর রহমানের আবির্ভাবের পর নতুন বলের অধিকার অধিনায়ক হয়েও হাসিমুখে ছেড়ে দিয়েছেন এই বিস্ময় বালককে। এখন মুস্তাফিজ নেই, আবার সেই নতুন বলটিও সামলাচ্ছেন অসাধারণ দক্ষতায়।

নতুন বলের প্রসঙ্গেই আবার চলে আসে ফিটনেস। শুধু কাটার নয়, গত আফগানিস্তান আর এই ইংল্যান্ড সিরিজে বেশ সুইংও আদায় করে নিয়েছেন। দ্বিতীয় ওয়ানডে শেষে সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ফিটনেসটা এখন দারুণ বলেই বোলিং হচ্ছে এতটা ছন্দময়, ফিরে পেয়েছেন সুইং।

ফিটনেস! শুরুর গল্পটায় ফেরা যায় অনায়াসেই। একটু বেশি ঝাম ঝরানো, যদি একটা উইকেট বেশি মেলে! রোদে পোড়া, ঘামে ভেজা বাড়তি সময়টুকুই তাকে উপহার দিয়েছে পোক্ত শরীর আর নিজের ওপর বিশ্বাস। প্রিয় খাবারের সঙ্গে আপোস, সকালে বিছানা ছাড়ার সময় থেকে শুরু করে ম্যাচের আগে নিক্যাপ পড়া, প্রতি পদক্ষেপে সতর্কতা আর শৃঙ্খলার পালা তো চলে নিত্য। সব মিলিয়ে গত ৫-৬ বছরে তার সেরা ফিটনেস সম্ভবত এখনই। ৩৩ বছর বয়সে ফিটনেস ক্যাম্পের ‘বিপ টেস্টে’ ছাড়িয়ে যান অনেক তরুণ ক্রিকেটারকে। তার অবসর নিয়ে অনেকের আগ্রহ, আলোচনাগুলোও যেন মুখ লুকিয়ে পালায় এই ফিটনেসের দাপটে!

এ এক আশ্চর্য নিবেদনের গল্প। শরীর চুইয়ে সবুজ ঘাসে মিশে যাওয়া বিন্দু বিন্দু ঘামই যেন ফুল হয়ে ফুটে ওঠে মাঝের ২২ গজে!