রোমাঞ্চকর ম্যাচে বাংলাদেশের স্বস্তির জয়

চোখ রাঙাচ্ছিল পরাজয়। ঘিরে ধরেছিল শঙ্কার কালো মেঘ। ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষাও যেন গিয়েছিল মিইয়ে। হঠাৎ যেন ফিরল সম্বিত, দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াল দল। আফগান চ্যালেঞ্জকে হারিয়ে শেষ পর্যন্ত জিতল বাংলাদেশ।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Sept 2016, 08:07 AM
Updated : 25 Sept 2016, 07:15 PM

ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানকে ৭ রানে হারিয়েছে মাশরাফি বিন মুর্তজার দল। এক সময় ম্যাচ ছিল প্রায় আফগানদের হাতের মুঠোয়। সাকিব আল হাসানের দারুণ একটি ওভার আর শেষ দিকে তাসকিন আহমেদের দুর্দান্ত বোলিংয়ে জিতে যায় স্বাগতিকরা।

তাসকিনের করা শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১৩ রান। বোলিং অ্যাকশন শুধরে ফেরা এই ফাস্ট বোলার দেন মাত্র ৫ রান। নিজের শেষ ২ ওভারে তাসকিন নেন ৪ উইকেট!

রোববার মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টস জিতে ব্যাট করতে নেমে শেষ বলে ২৬৫ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ। জবাবে শেষ বলে ২৫৮ রানে অলআউট হযে যায় আফগানিস্তান।

লক্ষ্য তাড়ায় শুরুতেই উইকেট হারাতে পারত আফগানিস্তান। তাসকিনের প্রথম ওভারে স্লিপে মোহাম্মদ শাহজাদের ক্যাচ ছাড়েন ইমরুল কায়েস। শূন্য রানে জীবন পাওয়া শাহজাদ ২১ বলে খেলেন ৩১ রানের আক্রমণাত্মক ইনিংস।

শাহজাদকে ফিরিয়ে প্রথম আঘাত হানেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। বোলিংয়ে এসেই শাবির নুরিকে ফেরান সাকিব। ৪৬ রানে দুই উইকেট হারানো আফগানরা প্রতিরোধ গড়ে রহমত শাহ ও হাশমতুল্লাহ শাহিদির ব্যাটে। এই দুই জন গড়েন ১৪৪ রানের জুটি। তৃতীয় উইকেটে এটাই আফগানদের সেরা জুটি।   

শুরুর সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। স্বাগতিকদের সাদামাটা বোলিংয়ের সুযোগ পুরোপুরি নেয় আফগানরা। শেষ পর্যন্ত আফগানদের প্রতিরোধ ভাঙেন সাকিব। তার বলে স্টাম্পড হন রহমত (৭১)। এই উইকেট নিয়ে আব্দুর রাজ্জাককে (২০৭) সরিয়ে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড নিজের করে নেন সাকিব।

তাইজুল ইসলামের আগের ওভারে ডিপ স্কয়ার লেগে মাহমুদুল্লাহকে সহজ ক্যাচ দিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন হাশমতুল্লাহ। তাইজুলের পরের ওভারে অনেকটা দৌড়ে ক্যাচ তালুবন্দি করেন সৌম্য সরকার।

ওয়ানডেতে প্রথম অর্ধশতক পাওয়া হাশমতুল্লাহর ১১০ বলে খেলা ৭২ রানের ইনিংসটি গড়া ৬টি চারে।

জয়ের আশা বাঁচিয়ে রাখতে নিজের শেষ ওভারে নাজিবুল্লাহ জাদরানকে ফেরান মাশরাফি। অধিনায়কের বলে মুশফিকের গ্লাভসবন্দি হন নাজিবুল্লাহ।

চার ওভারে ২৮ রান প্রয়োজন, এমন সময়ে নিজের ওভারটি করতে এসে মোটে এক রান দিয়ে বাংলাদেশকে খানিকটা এগিয়ে দেন সাকিব।

শুরুর অনুজ্জ্বল তাসকিন শেষটায় ফিরেন স্বরূপে। টানা তিনটি ফুল লেংথ বল, চতুর্থটি অফ স্টাম্পের বাইরে স্লোয়ার; সেটাই তাসকিনকে এনে দেয় মোহাম্মদ নবির উইকেট। সীমানার কাছে ছুটে গিয়ে ক্যাচ তালুবন্দি করেন সাব্বির রহমান। তাসকিনের সেই ওভারের শেষ বলে অধিনায়ক স্তানিকজাইয়ের ক্যাচ তালুবন্দি করেন মাহমুদউল্লাহ।

ম্যাচে তখন দারুণভাবে ফিরে বাংলাদেশ। তাসকিনের কাজটা সহজ করতে ৪৯তম ওভারে ৭ রান দিয়ে রশিদ খানকে ফিরিয়ে দেন রুবেল। 

উজ্জ্বীবিত তাসকিনের শেষ ওভারে জয়ের জন্য ১৩ রান প্রয়োজন ছিল। প্রথম বল থেকে দুই রান নেন মিরওয়াইস আশরাফ। পরের বলে পরেন এলবিডব্লিউর ফাঁদে। এরপর আর পেরে উঠেনি অতিথিরা। শেষ বলে দৌলত জাদরানকে ফিরিয়ে নিজের চতুর্থ উইকেট নেন তাসকিন।

তাসকিনের দুর্দান্ত বোলিংয়ে দেখা মেলে বাংলাদেশের অসাধারণ এক ঘুরে দাঁড়ানোর। এক সময়ে ৮ উইকেট হাতে ৭৬ রান প্রয়োজন ছিল আফগানদের। মুঠো থেকে ফস্কে যেতে বসা এই ম্যাচ কি দারুণ ভাবেই না জিতল মাশরাফির দল।  

৫৯ রানে চার উইকেট নেন তাসকিন। ১০ ওভারে মাত্র ২৬ রান দিয়ে দুই উইকেট নেন সাকিব। অধিনায়ক মাশরাফি দুই উইকেট নেন ২৬ রানে।

এর আগে ১০ মাস পর ওয়ানডে খেলতে নামা বাংলাদেশের শুরুটা ছিল নড়বড়ে। পঞ্চম বলেই ফিরে যান সৌম্য। দৌলতের বল পুল করতে গিয়ে টাইমিংয়ে গড়বড় করে মিডউইকেটে সহজ ক্যাচ দেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান।

তিন নম্বরে নামা ইমরুল শুরুতে কয়েকবার বেঁচে যান অল্পের জন্য। ১৩, ১৭, ২১ রানে ক্যাচ দিয়ে ফিরতে পারতেন তিনি। তবে ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পাওয়া এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের সঙ্গেই প্রতিরোধ গড়েন তামিম।

বিপজ্জনক হয়ে ওঠা দ্বিতীয় উইকেট জুটি ভাঙেন নবি। দ্বিতীয় স্পেলে ফেরা এই অফ স্পিনারের বল ইমরুলের ব্যাটের কানায় লেগে প্যাড হয়ে স্টাম্পে আঘাত হানে।

তৃতীয় উইকেটে মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে ৭৯ রানের আরেকটি কার্যকর জুটি উপহার দেন তামিম। রশিদ খানের বলে কাট করে চার হাঁকিয়ে ৬৩ বলে পৌঁছান অর্ধশতকে।  আশরাফের বল সীমানা ছাড়া করতে গিয়ে লংঅফে ক্যাচ দিয়ে শেষ হয় তার দারুণ ইনিংসটি।

৯৮ বলে ৯টি চারে ৮০ রান করার পথে দেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৯ হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন তামিম।

বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার সাকিবের সঙ্গে মাহমুদুউল্লাহর ৪০ রানের জুটিতে দুইশ’ পার হয় বাংলাদেশের সংগ্রহ। দৌলতের বলে লংঅন ও মিডউইকেটের মাঝ দিয়ে দারুণ এক চারে ৬৫ বলে অর্ধশতকে পৌঁছান এই মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যান।

রানের গতি বাড়ানোর চেষ্টায় নবির বলে সীমানায় আশরাফকে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন মাহমুদউল্লাহ। ৭৪ বলে খেলা তার ৬২ রানের ইনিংসটি গড়া ৫টি চার ও দুটি ছক্কায়।

৪১তম ওভারে বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল ৩ উইকেটে ২০৩ রান। তখনও মাঠে নামতে বাকি মুশফিক, সাব্বির রহমান ও মাশরাফির। সেখান থেকে ২৮০/২৯০ রান অসম্ভব ছিল না।

রশিদ খানের স্পিনে পরপর দুই ওভারে মুশফিক ও সাব্বির ফিরে গেলে চাপে পড়ে স্বাগতিকরা। বোল্ড হয়ে ফিরেন মুশফিক, বিতর্কিত সিদ্ধান্তে এলবিডব্লিউ হন সাব্বির। দুই ব্যাটিং ভরসার কেউই দুই অঙ্কে যেতে পারেননি।

বাংলাদেশকে আড়াইশর পথে রাখেন বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার সাকিব। কয়েকটি সহজ ক্যাচ হাতছাড়া আফগানরা এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানকে ফেরায় দুর্দান্ত এক ক্যাচে। ৪০ বলে তিনটি চারে ৪৮ রান করেন সাকিব।

অভিষেকে একটি উইকেট পেয়েছেন আফগানিস্তানের নাভিন-উল-হক। ১৭ বছর বয়সী পেসার ফিরিয়েছেন মাশরাফিকে।

৭ উইকেট হাতে থাকা বাংলাদেশ শেষ ১০ ওভারে ৬৯ রানের বেশি রান করতে পারেনি।

শেষের দিকে পারেনি আফগানরাও। দীর্ঘ বিরতির পর জয় দিয়েই তাই নতুন মৌসুম শুরু করলো বাংলাদেশ।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৬৫ (তামিম ৮০, সৌম্য ০, ইমরুল ৩৭, মাহমুউল্লাহ ৬২, সাকিব ৪৮, মুশফিক ৬, সাব্বির ২, মাশরাফি ৪, তাইজুল ১১, তাসকিন ২, রুবেল ১*; দৌলত ৪/৭৩, নাভিন ১/৬২, নবি ২/৪০, আশরাফ ১/৫১, রশিদ ২/৩৭)

আফগানিস্তান: ৫০ ওভারে ২৫৮ (নুরি ৯, শাহজাদ ৩১, রহমত ৭১, হাশমতুল্লাহ ৭২, নবি ৩০, নাজিবুল্লাহ ৭, স্তানিকজাই ১০, রশিদ ৭, আশরাফ ৩, দৌলত ২, নাভিন ০*; মাশরাফি ২/৪২, তাসকিন ৪/৫৯, সাকিব ২/২৬, রুবেল ‌১/৬২, তাইজুল ১/৪৪, মাহমুদউল্লাহ ০/২২)

ফল: বাংলাদেশ ৭ রানে জয়ী

ম্যাচ সেরা: সাকিব আল হাসান