অপুর কথা বলা শেষ হতে না হতেই চৌধুরী শামসুদ্দিন রুমী ফোন করল। রুমী আমার খুব কাছের মানুষ, ঢাকার প্রবীণ সাংবাদিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যক সালেহ চৌধুরীর ‘ভ্রাতুষ্পুত্র’। কয়েক বছর আগে সালেহ ভাই লন্ডন বেড়াতে এসে আমাকে রুমীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে রুমী আমাকে চাচা বলেই সম্মোধন করে এবং খুবই শ্রদ্ধা করে। অপর একটি টিকেট বরাদ্দ ছিল রুমীর জন্য। রুমীর গাড়িতে করেই হোভ যাওয়ার সমস্ত পরিকল্পনা করেছিলাম। রুমী ফোন করে বলল, ‘চাচা, মুস্তাফিজ তো খেলছে না, আপনারা তো আর হোভ যাচ্ছেন না। আমিও তো শুধু মুস্তাফিজ খেলবে বলেই যেতে চেয়েছিলাম। এখন মুস্তাফিজ খেলবে না জেনে অহেতুক ৮০ মাইল ড্রাইভ করে দুটি কাউন্টি দলের ম্যাচ দেখতে যাওযার কোন অর্থই হয় না।” মুস্তাফিজ না খেললেও আমরা হোভে যাচ্ছি শুনে রুমী অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাদের সাথে যেতে রাজি হলো। বলল, চাচা, ঠিক আছে, আমি যাব। কিছুক্ষণ পরে আমরা ভাবলাম, বেচারা রূমীকে শুধু শুধু এতো দূরে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই, আমরা দুজন ট্রেনেই হোভ চলে যাব। ওয়েবসাইটে ট্রেনের রিটার্ন টিকেট কেনার আগে রুমীকে আমাদের সিদ্ধান্তটা জানালে করলে রুমী খানিকটা অভিমান করে বলল, “চাচা, ট্রেনে যাবেন কেন? আমিই আপনাদের নিয়ে যাব। আমি তো ভেবেছিলাম, মুস্তাফিজ খেলবে না, তাই আপনারাও আর হোভ যাবেন না। ট্রেনের টিকেট কিনবেন না প্লিজ, আমিই আপনাদেরকে নিয়ে যাব।”
গণজাগরণ মঞ্চের নেত্রী অজান্তা দেব রায় দল-বল নিয়ে ওভালে গিয়েছিল মুস্তাফিজকে সমর্থন দেয়ার জন্য। সারে ক্লাবের সমর্থক পরিবেষ্টিত অবস্থায় অজান্তারা মুস্তাফিজ-মুস্তাফিজ আর বাংলাদেশ-বাংলাদেশ বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছে। তাদের উৎসাহ দেখে সারে ক্লাবের ইংলিশ সমর্থকরাও মুস্তাফিজ-মুস্তাফিজ আর বাংলাদেশ-বাংলাদেশ স্লোগান দিয়েছে। ওভালের ম্যাচে মুস্তাফিজ যদিও একটি দারুণ ক্যাচ ধরেছিলেন, তবে পুরো চার ওভার বল করে তিনি ছিলেন উইকেটশূন্য। তাই অজান্তাদের মতো ওভালের প্রায় হাজার খানেক বাঙালি দর্শক হতাশ হয়েই বাড়ি ফিরেছিলেন। তাই মুস্তাফিজ জাদু দেখার জন্য অজান্তারা হোভে যাওয়ার পূর্ণ প্রস্ততি নিয়েছিল। বুধবার অজান্তা বলল, “আমি সহ বেশ কয়েকজন ইতোমধ্যেই টিকেট কিনেছিলাম। কিন্তু মুস্তাফিজ খেলবে না বলে আমরা আর হোভে যাচ্ছি না।”
এদিকে ব্রাইটনের কাছে গিয়ে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু ইমামুজ্জামান মহিকে ফোন করলে মহিও জানালেন, তিনিসহ আরও কয়েকজনের আজকের ম্যাচ দেখার কথা ছিল। কিন্তু তাদের কেউই ম্যাচ দেখতে আসছেন না। মহি আরও বললেন, “আমরা তো ক্রিকেট নিয়ে মাথা ঘামাইনা। কিন্তু মুস্তাফিজ আসাতে সাসেক্সের সব বাঙালিরা এখন সাসেক্সের সমর্থক হয়ে গেছি। কিন্তু মুস্তাফিজ না খেললে আমরা কাজ-কর্ম ফেলে সাসেক্স ক্লাবকে সমর্থন দেয়ার জন্য স্টেডিয়ামে যেতে রাজি নই।”
স্টেডিয়ামে ঢোকার আগেই অবশ্য দুই পোস্টারের একটি নীলু উপহার দিল সাসেক্স ক্লাবের প্রধান নির্বাহী জ্যাক টুমাজিকে। জ্যাক জানালেন মুস্তাফিজকে তিনি অনুরোধ করবেন এতে অটোগ্রাফ দিতে। এরপর ক্লাবের জাদুঘরে পোস্টারটি রাখা হবে।
জ্যাক জানালেন আইপিএল শুরুর আগে থেকেই মুস্তাফিজকে তারা চুক্তিবদ্ধ করেছিলেন। জানালেন মুস্তাফিজের প্রথম ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতা, “আমি স্ট্যান্ডে বসে এসেক্সের বিপক্ষে তাদের সমর্থকদের সঙ্গেই মুস্তাফিজের প্রথম ম্যাচ দেখেছি। একজন আমাকে বললো, কেন আপনি এই তরুণকে নিয়েছেন। মুস্তাফিজ যখন তার দ্বিতীয় ওভারেই উইকেট নিল আমি ওই লোকটাকে বললাম, ‘এই জন্যই আমি তাকে দলে নিয়েছি’।”
মুস্তাফিজের জাদু স্বচক্ষে দেখার জন্য বাঙালিরা তো দলে দলে সাজ-সাজ রব করে হোভে আসার প্রস্তুতি নিয়েছিল। তার খেলা দেখতে পারবে না বলে বাঙালিরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাই জেনে শুনে মুস্তাফিজের অনুপস্থিতিতে তারা স্টেডিয়ামে আসবে কোন দুঃখে। হতাশ হবেনই বা না কেন? তারা তো মুস্তাফিজের জাদু দেখার জন্যই উদগ্রীব ছিলেন। আমিও তো হতাশ হয়েছি। ওভালের ম্যাচে হারার পর হিসেব-নিকেশ করে বের করেছিলাম যে, হোভে ন্যাটওয়েস্ট টি-টোয়েন্টি ব্লাস্ট এর গ্রুপ পর্যায়ের আজকের শেষ ম্যাচটিতে গ্ল্যামরগ্যানের বিপক্ষে ভালোভাবে জিততে পারলে সাসেক্স ক্লাবের কোয়ার্টার-ফাইনালে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সাসেক্স যদি কোয়ার্টার-ফাইনালে যেতে পারে তাহলে আমরা গ্যালারিতে বসে স্বচক্ষে কাটার মাষ্টার মুস্তাফিজের আরও কয়েকটি ম্যাচ দেখার সুযোগ পাব। কিন্তু মুস্তাফিজের অনুপস্থিতিতে সাসেক্সের শেষ আটে পৌঁছানো দুরূহ হয়ে পড়েছে। আর কোনোক্রমে যদি তারা কোয়ার্টার-ফাইনালে পৌঁছতেও পারে তাতেও কিছু আসে যায় না। কারন মুস্তাফিজকে ছাড়া খেলা দেখার আগ্রহ আমাদের থাকবে না।
তবে যারা এই দফা মুস্তাফিজের জাদু দেখা থেকে বঞ্চিত হলেন, তাদের বেশি দিন হতাশ থাকতে হবে না, আগামী বছরের জুন মাসেই ইংল্যান্ডে বাংলাদেশ জাতীয় দল আইসিসি আয়োজিত চ্যাম্পয়নশিপ ট্রফিতে অংশ নেবে। গত বছর দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে, অর্থাৎ একের পর এক জিম্বাবুয়ে, পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে বাংলাদেশ আইসিসির ওডিআই র্যাঙ্কিং এর নয় থেকে সাতে উঠে চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। আইসিসি ওডিআই র্যাংঙ্কিং এর প্রথম আটিটি দল চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফিতে অংশ নেবে। মুস্তাফিজের আবির্ভাবের ফলেই বাংলাদেশ গত বছর এই সাফল্য অর্জন করেছিল। পাকিস্তানকে ধবল ধোলাই করেছিল বাংলাদেশ। আর সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশ জিতেছিল ২-১ ব্যবধানে। ভারতকেও একই ব্যবধানে হারিয়েছিল সাকিব-মুশফিকরা।
হোভ, ২৮ জুলাই, ২০১৬
(লেখক আবু মুসা হাসান সাবেক কূটনীতিক ও সাংবাদিক)