বাসা থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড টিউবে লন্ডনের লিভারপুল স্টেশনে গিয়ে ব্রিটিশ রেলে চেমসফোর্ড ট্রেন স্টেশনে পৌঁছলাম। স্টেশন থেকে বের হয়ে এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে ক্রিকেট স্টেডিয়ামে হেঁটে যাওয়ার পথটা জেনে নিলাম। পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে স্টেডিয়ামে যাওয়ার পথটা আবার নিশ্চিত হতে চাইলাম। বলল, আমিও যাচ্ছি, আমার সাথে চলেন। ভদ্রলোক দীর্ঘদিন ধরে এসেক্স কাউন্টি ক্লাবের সদস্য, নিয়মিত খেলা দেখেন। জানতে চাইল, আমি কোথা থেকে এসেছি। বললাম, লন্ডন থেকে; আসলে আমি বাংলাদেশের। আমাদের বাঁহাতি পেস বোলার মুস্তাফিজ আজ তোমাদের দলের বিপক্ষে খেলবে। গ্যালারি থেকে আমি এখনও ওর বোলিং দেখিনি। মুস্তাফিজ আইপিএলে বাজিমাত করে এসেছে। বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানরা ওর বল খেলতে রীতিমতো হিমশিম খেয়েছে। তাই নিজের চোখে ওর বোলিং জাদু দেখার জন্য এসেছি।
তবে মুস্তাফিজের বোলিং স্পেল শুরু হলে এসেক্স ক্লাবের উৎফুল্ল দর্শকদের চুপসে যাওয়ার দৃশ্য গ্যালারিতে বসে খুব ভালোভাবেই দেখেছি। আমি যে স্ট্যান্ডে বসে খেলা দেখছিলাম, তার চৌহদ্দিতে কোনো বাঙালি তো দূরের কথা, আমার গায়ের রংয়ের কাছাকাছি কোন দর্শকও নজরে পড়েনি। আগে ব্যাট করতে গিয়ে সাসেক্সের ব্যাটসম্যানরা চার মারলেও কোনো দিকে কোনো করতালি নেই, আর এসেক্সের ফিল্ডাররা একটা চার ঠেকাতে পারলেই পুরো স্টেডিয়াম গর্জে উঠছিল। মুস্তাফিজের বদৌলতে আমিও তো সাসেক্স সমর্থক বনে গেছি। তাই এসেক্স ক্লাবের শত শত সমর্থক পরিবেষ্টিত অবস্থায় চুপচাপ খেলা দেখছিলাম। ফোনে কথা বলার সময় লন্ডনের সাপ্তাহিক জনমতের সম্পাদক নবাব উদ্দিনকে বলছিলাম, এখন না হয় চুপচাপ বসে সাসেক্সের ব্যাটিং দেখছি। কিন্তু মুস্তাফিজ যখন বল করে উইকেট শিকার করবে তখন তো আর চুপ করে থাকা যাবে না। একা একা আমি চিৎকার দিয়ে উঠলে কী অবস্থা হয় কে জানে!
সাসেক্সের বোলিং করা শুরু হলে আমরা অধীর আগ্রহে মুস্তাফিজের বোলিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এদিকে এসেক্সের সমর্থকরা প্রতিটি চারের মারের পরই চিৎকারে আমাদের কান ঝালাপালা করে দিচ্ছিল। আমি আমার নতুন সঙ্গীদের বললাম, একটু অপেক্ষা করো, মুস্তাফিজ বল করা শুরু করলেই ওরা চুপসে যাবে। কিন্তু দ্বিতীয় ওভারেই বাউন্ডারি লাইনের কাছাকাছি আমাদের গ্যালারির খুব কাছে মুস্তাফিজ একটি দুর্দান্ত ক্যাচ নেয়ার পর আমরা সবাই মুস্তাফিজ-মুস্তাফিজ করে চিৎকার দিয়ে উঠলাম।
মুস্তাফিজের উইকেট শিকার শুরু হলে, বিশেষ করে অষ্টাদশ ওভারে দুটি উইকেট নিলে এসেক্স সমর্থকরা জয়ের আশা ছেড়ে দিয়ে গ্যালারি ছাড়া শুরু করে। আর আমরা প্রাণভরে আনন্দ উল্লাস করতে থাকলাম। খেলা শেষ হওয়ার পর প্যাভিলিয়নের সামনে গিয়ে আরও একদল বাঙালি পেলাম। লন্ডনে বসবাসরত ঝিনাইদহের এক উৎসাহী যুবক ইসমাইল হোসেন এবং আশরাফুল নামে আরও একজন ভদ্রলোককে পেলাম, যারা বাংলাদেশের জার্সি পড়ে খেলা দেখতে এসেছিল। খেলা দেখতে আসা ব্যারিস্টার মামুন কাদরী ও ব্যারিস্টার সোহেল জানালেন যে, তাদের ধারণা, প্রায় ১০০ জন বাঙালি দর্শক স্টেডিয়ামে ছিল।
মুস্তাফিজের কারিশমা দেখার জন্য আজ সন্ধ্যায় যাচ্ছি ওভালে। সারের বিপক্ষে লন্ডন সময় সাড়ে ছয়টায় এবং বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায় মুস্তাফিজের দল সাসেক্স মাঠে নামবে। আজ অবশ্য একা নয়, পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক দলবল নিয়ে খেলা দেখার জন্য আগেই টিকেট করে রেখেছি। টিকেট না পাওয়াতে আমার সহধর্মিনী নীলু গতকাল মুস্তাফিজের অভিষেক ম্যাচ দেখতে পারেনি। আজ আমার পাশে নীলুও থাকবে। আশা করছি আজও মুস্তাফিজ জাদু দেখাবে।
লন্ডন, ২২ জুলাই, ২০১৬
(লেখক সাবেক কূটনীতিক ও সাংবাদিক)