প্রশ্ন: আইপিএল দেখছেন? মুস্তাফিজ তো দারুণ করছে!
মাশরাফি বিন মুর্তজা: আমি শুধু মুস্তাফিজের চার ওভার, আর সাকিবের ব্যাটিং-বোলিং দেখি। মুস্তাফিজের পারফরম্যান্স অবশ্যই প্রত্যাশিত ছিল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই বড় বড় ব্যাটসম্যানরা হিমশিম খেয়েছে ওকে পড়তে। আইপিএলে তো চারজন বিদেশি, সাতজন ভারতীয়। সেখানে আরও ভালো করারই কথা। একটুও অবাক হইনি। ওর কাছে এমন পারফরম্যান্সই প্রত্যাশিত ছিল। আইপিএল শুরুর আগেই একটি সাক্ষাৎকারে আমি বলেছিলাম, মুস্তাফিজ সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হবে, অন্তত সেরা তিনে থাকবেই। আমি এখন সেদিকেই তাকিয়ে।
আইপিএলে তো মাঠের বাইরেও অনেক ব্যাপার থাকে। প্রথমবার দেশের বাইরে গেল একা একা, ভাষার সমস্যা, এত গ্ল্যামার, এত ভ্রমণ, ভিন্ন একটা জগত। সেখানে এত দ্রুত মানিয়ে নেওয়াতে অবাক হননি?
মাশরাফি: আমি জানতাম এসব ওর কোনো সমস্যা হবে না। ওর যে ক্রিকেটিং স্কিল আছে, সেটা দিয়েই সে সব ঘাটতি বা আর সব কিছুকে ছাপিয়ে যেতে পারে। মাঠের বাইরে যদি অস্বস্তিতেও থাকে, কিংবা ধরুণ, ১০-১২ দিন যদি অনুশীলন না করে শুধু ঘুমিয়েই কাটায়, তার পরও ম্যাচে গিয়ে ঠিকই ওর স্কিলটা কাজে লাগাতে পারবে। চোখ বন্ধ করে কাটার করতে পারবে। এতটাই সহজাত ওর এই বিশেষ স্কিল। এজন্যই আমার কোনো চিন্তা ছিল না ওকে নিয়ে। আমরা অনেক সময় বলি, অমুক তমুকের চেয়ে কয়েক পদক্ষেপ এগিয়ে আছে। মুস্তাফিজ ওর স্কিল দিয়ে আর সবার চেয়ে অনেক অনেক পদক্ষেপ এগিয়ে আছে।
আপনারা ওকে কাছ থেকে দেখেন সবসময়। যতটা মনে হয়, আসলেই কি ততটা আনপ্লেয়েবল সে? নাকি ইমপ্রেশনের কারণে অনেক ব্যাটসম্যান সঙ্কুচিত থাকে?
ভারতের বেশিরভাগ উইকেটই নিখাদ ব্যাটিং স্বর্গ, ততটা গ্রিপ করে না বল। তার পরও মুস্তাফিজ এত সফল কি বৈচিত্রের কারণেই?
মাশরাফি: গ্রিপ করলে ওর জন্য ভালো। তবে এখন আর গ্রিপ না করলেও চলে ওর জন্য। যেটা বললাম, এত এত অস্ত্র এখন ডেভেলপ করেছে ও। এখন সে ১৪২-১৪৩ কিমি গতিতে বল করছে, সেটাও ক্রস সিম। আবার স্লোয়ার-কাটারে সেটা ২০ কিমি কমে আসছে। ব্যাটসম্যানের জন্য অ্যাডজাস্ট করা খুব কঠিন। ব্যাটসম্যানরা প্ল্যানই করতে পারছে না, মানসিকভাবে থিতু হতে পারছে না। ইয়র্কারওটাও নিঁখুত করছে। স্টাম্পে ইয়র্কার করছে, ওয়াইড ইয়র্কার করছে।
১৪২-১৪৩ কিমি গতিতে বল করছে, এই গতি দেখে অবাক হননি?
মাশরাফি: বিশ্বকাপেও ১৩৮-১৪০ করেছে। ও যে উন্নতি করছে, সেটার আরেকটি প্রমাণ। গতি বেড়েছে বলে ওর স্লোয়ার ও কাটারগুলি আরও কার্যকর হয়ে উঠেছে। এখনও তো ওর বয়স কম, পেশি ততটা শক্ত হয়নি। আমার বিশ্বাস, গতি ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। অবশ্য ওর যে স্কিল আছে, না বাড়লেও ক্ষতি নেই।
ইয়র্কারটা এত ভালো করছে দেখে বিস্মিত হননি? কদিন আগেও এত নিখুঁত ছিল না!
‘কুইক লার্নার’ এই কথাটি সবাই বলছে। আইপিএলে তার অধিনায়ক, টিম ম্যানেজমেন্টের অন্যরা, ধারাভাষ্যকার-বিশেষজ্ঞরা, সবাই বলছে মুস্তাফিজের ক্রিকেট ব্রেইন দারুণ। আপনার মূল্যায়ন কি?
মাশরাফি: এখানে ন্যাচারাল ব্যাপার কিছু তা আছেই। ও খুব দ্রুত সবকিছু ধরতে পারে। বছরখানেক হলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেছে এবং দলে ঢোকার পর থেকেই নিয়মিত খেলছে। কিছু অভিজ্ঞতাও হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা সে খুব ভালো কাজে লাগায়। ব্যাটসম্যানকে দ্রুত পড়তে পারে। আর সৃষ্টিকর্তা তো স্পেশাল একটা উপহার দিয়েছেই, ‘কাটার’। সব মিলিয়ে সে খুব স্মার্ট বোলার।
আর একটা ব্যাপার হলো, জীবনের সেরা জায়গায় কেউ থাকলে, আস্তে আস্তে মাথা খুলতে থাকে। ক্রিকেট মাঠের পারফরম্যান্সের ইতিবাচক প্রভাব জীবনেও পড়ে। আবার জীবন গোছানো হলে সেটার ইতিবাচক প্রভাব মাঠের পারফরম্যান্সে পড়ে। সব মিলিয়েই হচ্ছে।
আইপিএলে নিজের ফিল্ডিং মুস্তাফিজ নিজেই সাজাচ্ছেন বেশিরভাগ সময়, একজন তরুণ বোলারের ক্ষেত্রে যেটি খুবই বিরল। বাংলাদেশ দলেও কি এমনটি হয়, নাকি আপনি সাজান?
যতটা দারুণ বোলিং করছে, উইকেট তত বেশি পায়নি। সেটা কি তাকে ব্যাটসম্যানরা খুব সতর্কভাবে খেলছে বলে?
মাশরাফি: এটা ঠিক, আমি আশা করেছিলাম, এর মধ্যেই ওর অন্তত একবার ৪-৫ উইকেট হয়ে যাবে। কিন্তু উইকেট পাবে কী, সবাই এমনভাবে পরাস্ত হয়, ব্যাটেই তো লাগে না বল! বার বার পরাস্ত হচ্ছে। ম্যাককালামের মত ব্যাটসম্যানও কিছুই বুঝতে পারেনি!
ওকে সতর্কভাবে খেলার ব্যাপার তো আছেই। উইকেট পাওয়া ভাগ্যেরও ব্যাপার। হয়ত সামনেই এক ম্যাচে অনেক উইকেট পেয়ে যাবে। আমার বিশ্বাস, সামনে আরও ভালো করবে। আগেই বলেছি, সেরা তিনে দেখার আশা করছি।
এখনও পর্যন্ত তার সেরা পারফরম্যান্স কিংবা সেরা ডেলিভারি, কোনটি বলবেন?
তবে সেরা ডেলিভারি বললে, যেহেতু ওর কাছ থেকে এমন নিখুঁত ইয়র্কার অনেকেই আশা করেনি এবং ব্যাটসম্যান বল ঠেকাতে গিয়ে পড়েই গেছে, সব মিলিয়ে আন্দ্রে রাসেলের উইকেটিই।
জনমনে প্রবল ভয়, প্রশ্ন; আইপিএল খেলায় মুস্তাফিজের কারিকুরি যদি সবাই ধরে ফেলে!
মাশরাফি: যুক্তি আছে, কিন্তু এই যুক্তির কোনো মূল্য নেই! পৃথিবীর নিয়মই এমন। বুঝে ফেলবে বলে কি মুস্তাফিজ না খেলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে! ও যেটা করতে পারত, সেটা খুব ভালোভাবে করছে। কাটার ওর আল্লাহপ্রদত্ত, কিন্তু শুধু সেটা নিয়েই বসে নেই। আরও অনেক কিছু ডেভেলপ করেছে, ইয়র্কার, বাউন্সার, ক্রস সিম ডেলিভারি। আরও উন্নতি করবে। এসবে ওর কাটারও কিন্তু আরও কার্যকর হয়েছে। ব্যাটসম্যানরা বুঝে উঠতেই পারছে না। কাজেই শঙ্কার কিছু নেই। বরং আরও ধারালো হয়ে উঠবে সে।
ডানহাতি ব্যাটসম্যানের জন্য ভেতরে ঢোকা বলটি শিখতে পারলে তো আরও দারুণ হয়!
তবে ওর বয়স মাত্র ২০, এখনই অনেক অনেক অস্ত্র আছে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আস্তে আস্তে সব শিখে যাবে।
কিন্তু এত খেলার ধকল মুস্তাফিজ কতটা সইতে পারবে? ওকে সামলানো কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং কার দায়িত্ব কতটা?
মাশরাফি: ভবিষ্যতের পথচলায় এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নিজের দেখভাল নিজেকেই সবচেয়ে বেশি করতে হয়। মুস্তফিজ সেটা খুব ভালোভাবেই পারে। জিম করে, খুব নিয়ম মেনে চলে। খুবই গোছানো ছেলে। এই জায়গাটায় তাই আমার চিন্তা কম।
আমি তাই বলব, ওকে খুব সতর্কভাবে ঠিক করতে হবে, কোনটা খেলবে, কোনটা খেলবে না। কারণ দিনশেষে এসব টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে আর্থিক লাভ ছাড়া ক্রিকেটীয় লাভ খুব বেশি নেই। পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে ওর আর্থিক দিকটা অবশ্যই দেখতে হবে। আইপিএল স্বাভাবিকভাবেই খেলতে চাইবে, বিপিএল তো আমাদের লিগ। এর বাইরে আর্থিকভাবে খুব লাভবান হবে, এমন লিগেই শুধু খেলা উচিত। সেটাও নিজের শরীরের সঙ্গে আপোশ না করে।
ওর পরিবার, আশেপাশের লোকজন, আমাদের বোর্ড, সবারই দায়িত্ব আছে। মেশিনও বিশ্রাম না পেলে নষ্ট হয়ে যায়; ওর শরীর তো মেশিন নয়! মুস্তাফিজ বাংলাদেশের সম্পদ, এটা বুঝতে হবে। ওর কাছ থেকে সর্বোচ্চ সার্ভিস যেন বাংলাদেশ পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। অন্তত ১০-১২ বছর যেন বাংলাদেশের হয়ে খেলতে পারে। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বদলে দেবে মুস্তাফিজ।