কোহলিকে প্রেরণা মেনে মুমিনুলের নতুন লড়াই

চৈত্রের দুপুরের কাঠফাটা রোদ। সূর্যের তাপ আর গরম হাওয়া গায়ে বুলিয়ে দিচ্ছে যেন আগুনের হলকা। এই দাবদাহের মাঝেই মিরপুর একাডেমি মাঠের এক প্রান্তে ট্রেনারের তত্ত্বাবধানে রানিং করছিলেন তিন ক্রিকেটার। উঠতি উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান জসিমউদ্দিন, ঘরোয়া লিগের নিয়মিত পারফরমার অলরাউন্ডার তানভীর হায়দার, সঙ্গে মুমিনুল হক!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 April 2016, 05:40 PM
Updated : 5 Oct 2016, 02:09 PM

দীর্ঘ রানিং সেশনের প্রথম পর্ব শেষে ১৫ সেকেন্ডের বিরতি। ক্লান্তিতে প্রায় নুয়ে পড়ছিলেন জসিম। এগিয়ে গিয়ে পিঠে হাত রেখে মুমিনুল বললেন ‘খারাপ লাগছে? এনজয় দা পেইন, ম্যান!”

‘এটাই কি আপনার মন্ত্র এখন?’ আচমকা প্রশ্ন শুনে ফিরে তাকালেন মুমিনুল। ঘেমে-নেয়ে একাকার। ঘর্মাক্ত মুখে তবু ফুটে উঠলো আন্তরিক হাসি, “বলতে পারেন এটাই মন্ত্র…কষ্ট করতে হবে। ফিটনেস নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছি। কোহলির মতো হতে হবে।”

‘কোহলির মত!’ অবাক চাহনি দেখে ফের হাসেন মুমিনুল, “একটু অপেক্ষা করুন, দেখুন আমরা কত কষ্ট করি! রানিং শেষে কথা বলছি।”

কোহলির মত কিংবা কাছাকাছি!

রানিং শেষ হলো আরও আধ ঘণ্টা পর। একাডেমি মাঠের কোণায় কংক্রিটের ছোট্ট শেডে যান্ত্রিক পাখার তলে জিরিয়ে নেন মুমিনুল। ঘামে ভেজা জবজবে শরীরে লেপ্টে আছে গায়ের পোশাক। হাতে পানির বোতল, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে খোলাসা করলেন বিরাট কোহলিকে টেনে আনার কাহিনী।

“কোহলি তো গত কয়েক বছর ধরেই বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। অসম্ভব ধারাবাহিক। তবে সত্যি বলতে এই বিশ্বকাপে তাকে দেখে আমি দারুণ অনুপ্রাণিত। কী দুর্দান্ত ফিটনেস! মারে আর দৌড়ায়। ফিটনেসই তাকে এগিয়ে রাখে। কিভাবে সিঙ্গেল চুরি করে। এক রানকে দুই, দুই রানকে তিন বানায়!”

“কোনো আনঅর্থোডক্স শট কিংবা গায়ের জোরে বড় শট খেলে না। ক্রিকেট শট খেলে, গ্যাপ বের করে। রানিং বিটুইন দা উইকেট দুর্দান্ত। ছক্কার ঝড় নেই, দৌড়েই ৩০-৪০ রান নেয়, দেখা যায় ঠিকই ৫০ বলে ৮০-৯০ রান হয়ে গেছে। আমার মনে হয়েছে, ফিটনেসটা ওই জায়গায় নিয়ে যেতে পারলে হয়ত আমিও পারব।”

শেষ লাইনটাতেই ফুটে উঠল ফিটনেস নিয়ে তার উঠে পড়ে লাগার কারণ। জিততে চান সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভালো করার চ্যালেঞ্জ।

জাতীয় দলের হয়ে সবশেষ খেলেছেন গত অগাস্টে। কিন্তু তিনি দলের বাইরে নন। মুমিনুল আটকা পড়ে আছেন এই ছকেই। টেস্ট দল বাছতে গেলে একদম শুরুর দিকেই বসাতে হয় তার নাম। কিন্তু ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর আর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে খেলার সুযোগ হয়নি। ব্রাত্য ওয়ানডেতেও। সবশেষ ওয়ানডে খেলেছেন গত বছরের শুরুতে বিশ্বকাপে। গত কয়েক মাস বাংলাদেশ দল ব্যস্ত সময় কাটালেও মুমিনুলের ব্যস্ততা ছিল স্রেফ ঘরোয়া ক্রিকেট আর মিরপুরের ইনডোরে নিজের একান্ত অনুশীলনে!

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শের-ই-বাংলায় ক্রিকেট অনুশীলন। বিকেল থেকে বাকি সময়টুকু একান্তই তার নিজের। বসুন্ধরায় নিজের সদ্য কেনা ফ্ল্যাটে একাই থাকেন। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খুব মন দিয়ে দেখেছেন। মাথায় নিয়েছেন অনেক কিছুই। তবে শেষ পর্যন্ত অনুসরণ ওই একজনকেই, বিরাট কোহলি।

‘সম্ভব কোহলির জায়গাটায় যাওয়া?’ প্রশ্নের চ্যালেঞ্জটা একইরকম ঝাঁঝ দিয়ে ফিরিয়ে দিলেন মুমিনুল, “কেন সম্ভব নয়? মানুষই তো! আর সম্ভব-অসম্ভব পরের কথা। চেষ্টা তো করতে হবে! কোহলির মতো না হতে পারি, কাছাকাছি যেতে পারাটাও হবে অনেক কিছু।”

ইনডোরের লড়াই

আলাপচারিতার মাঝেই দৃশ্যপটে আবির্ভাব জাতীয় দলের ফিজিও বায়েজিদুল ইসলাম খানের। ছুটি কাটিয়ে মাত্রই ফিরেছেন। এগিয়ে গেলেন মুমিনুল, ফিজিওর সামনে মেলে ধরলেন হাত। ডাক্তার-ফিজিওকে দেখলেই নাকি লোকের নানা রোগ-সমস্যার কথা মনে পড়ে! তবে মুমিনুলের সমস্যাটি সত্যিকারের। মেলে ধরা হাতে দৃশ্যমান হলো তালুতে ক্ষত!

ইনডোরে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাটিং করে করে তালুতে প্রায় গভীর ক্ষতের মত হয়ে গেছে। মারাত্মক কিছু অবশ্য নয়। ফিজিও কিছু দাওয়াই বাতলে দিলেন। ব্যাটের গ্রিপও বদলাতে বললেন।

টেস্টে নিজেকে আরও শাণিত করা আর সীমিত ওভারের ক্রিকেটের ফেরার লড়াইয়ে মুমিনুলের কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে ফিটনেস। তবে অবশ্যই ব্যাটিং ভুলে নয়। বরং সবচেয়ে বেশি সময় দিচ্ছেন ব্যাটিং অনুশীলনেই।

গত কিছু দিন ধরেই তার দৈনিক রুটিন, সকাল সাড়ে নটার মধ্যে মিরপুর চলে আসা। ইনডোরে টানা ব্যাটিং অনুশীলন। দুপুরে জিম সেশন ও রানিং। মৌসুম শেষ, খেলা নেই। কিন্তু নিজেকে ছুটি খুব কমই দেন মুমিনুল।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইনডোরে কাটানো স্রেফ ব্যাটিংয়ের স্বার্থে ব্যাটিং করে যাওয়ার জন্যই নয়। সুনির্দিষ্ট শট ধরেই কাজ করছেন। তার বিকেএসপির কোচ ও ‘মেন্টর’ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন মালেয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির অধ্যায় শেষে এখন থিতু দেশে। কোচও নিয়মিত সান্নিধ্য দিচ্ছেন প্রিয় ছাত্রকে। দুজনে মিলে চলছে ব্যাটিং ঝালাই।

“যে শটগুলো ভালো খেলি, কাট-সুইপ-ড্রাইভ, সেগুলি আরও বেশি করে প্র্যাকটিস করছি,” বলে যান মুমিনুল, “এই শটগুলিই আমাকে বেশি রান দেবে। এগুলো নিখুঁত হওয়া জরুরি। যেন একটাও মিস না হয়।”

পাশাপাশি কাজ করছেন ঘাটতির জায়গাগুলি নিয়েও। সবগুলো বিস্তারিত খোলাসা করতে চাইলেন না। তবে আলাদা করেই শোনালেন একটি শটের কথা।

“গত মৌসুমে আমি যেটি খেয়াল করেছি, প্রতিপক্ষ আমার শক্তির জায়গাগুলি ধরে ফেলেছে। কাট ভালো খেলি, ড্রাইভ-কাভার ড্রাইভ…তারা আমাকে এখন ড্রাইভিং লেংথে বা কাট করার বল দেয় না। এজন্যই আমার মনে হয়েছে, শটের রেঞ্জ বাড়ানো দরকার। বিশেষ করে স্পিন বোলিংয়ে।”

“একটি শট নিয়ে যেমন কাজ করছি, স্পিনে ডাউন দা উইকেট এসে লফটেড শট। এটা নিখুঁত করতে পারলে অনেক উপকার। রান আসে, বোলারের লেংথও হারিয়ে যায়। শুধু ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টিতে নয়, টেস্টেও এই শট কাজে দেবে, ফিল্ডার তো ভেতরে থাকে। তবে এই শটে বল বাছাইটা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। কোন বলে বেরিয়ে আসব, সেটা।”

ব্যাটিং নিয়ে এত ঘাম ঝরানোর একটিই উদ্দেশ্য। নিজেকে সমৃদ্ধ করা। সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলা।

“ব্যাটিংটা আইফোনের মতো। সময়ের সঙ্গে আপডেট ভার্সন বের করতে হয়। আমিও শটের রেঞ্জ বাড়াচ্ছি। নিজেকে আপডেট ও আপগ্রেড করছি। প্রতিপক্ষ যেমন আমাকে শক্তির জায়গায় বল দেয় না এখন, আমিও আগামী মৌসুমে প্রতিপক্ষকে দেখিয়ে দিতে চাই আমার আরও শট আছে।”

‘কঠিনেরে ভালবেসে’ এগিয়ে চলা

বাংলাদেশ দল ও পুরো বাংলাদেশ যখন ডুবে আছে টি-টেয়্টে বিশ্বকাপে, মুমিনুলরা তখন খেলছেন বিসিএলে চারদিনের ক্রিকেট। ৬ ম্যাচে ৫৪.৭৭ গড়ে মুমিনুল করেছেন ৪৯৩ রান। বেশ ভালো পারফরম্যান্স, তবে ঠিক সন্তুষ্ট নন তিনি।

“টেস্টের তিন নম্বর ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে আপনি কি চান? দেড়শ-দুইশ-আড়াই রানের ইনিংস। বিসিএলে আমার একটা সেঞ্চুরি, আর তিন ইনিংসে ৮০-৯০। এই তিনটি ইনিংস ১৭০-২০০ করতে পারলে ভালো হতো। দীর্ঘ সময় উইকেটে থাকার, বড় ইনিংসের অভ্যাস হতো।”

গত মৌসুমেও এই সমস্যা দেখা গেছে মুমিনুলের ব্যাটিংয়ে। এমনিতে বড় ইনিংস খেলার জন্য পরিচিত হলেও গত বছর থিতু হয়ে আউট হয়েছেন বারবার। প্রথমবারের মতো টেস্টে কেটেছে শতকবিহীন বছর। ৫ টেস্টে ফিফটি ছিল মাত্র দুটি, গড় ৩৬.৮৫। এক সময়ের ‘ব্রাডম্যানীয়’ গড়টাও তাই নেমে এসেছে মানবীয় পর্যায়ে, ৫৬!

মুমিনুল জানালেন, তার ব্যাটিং অনুশীলনে এই ব্যাপারটি ভাবনায় থাকছে ভালোমতোই।

“স্যারের (কোচ সালাউদ্দিন) সঙ্গে এটা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। গত মৌসুমে একটু ফ্ল্যাশি ছিলাম। সেটা কমানো, আরেকটু কন্ট্রোল্ড শট খেলা, ডিফেন্স কমপ্যাক্ট করা, বল বেশি বেশি ছাড়া, এসব নিয়ে কাজ করছি।”

সামনেই ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। ওয়ানডে ব্যাটিংয়ে উন্নতি কতটা হলো, প্রমাণ মিলতে পারে সেখানে। আর টেস্টের মুমিনুলকে দেখতে অপেক্ষা আরেকটু দীর্ঘ। আগামী অগাস্টে, ভারতের মাটিতে টেস্ট। চোট না বাধালে ১৩ মাস পর আবার খেলবেন জাতীয় দলের হয়ে।

টেস্ট ব্যাটসম্যানের তকমা গায়ে লাগার পর এটাই তার নিয়তি। দীর্ঘদিন পর পর খেলতে হয়। কাজটা কঠিন। কিন্তু মুমিনুলের আপত্তি সামান্যই!

“কঠিন তো বটেই। কিন্তু মানিয়ে নিতেই হবে। আমি বরং এভাবে ভাবছি, অন্যরা টি-টোয়েন্টি খেলেছে, আমি বিসিএল খেলেছি। চার দিনের ম্যাচ খেলায় এখানে আমি এগিয়ে থাকব!”

টেস্টের মুমিনুল এগিয়ে আছেন। তবু নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা। রঙিন পোশাকে রঙিন আর সাদা পোশাকে আরও শুভ্র হওয়ার লড়াই। নতুন মৌসুমে অপেক্ষা নতুন মুমিনুলকে দেখার।