ইতিহাস গড়ে ইডেনে ক্যারিবিয়ান উৎসব

শেষ ৬ বলে চাই ১৯ রান। ছক্কা, ছক্কা, ছক্কা ও ছক্কা! প্রথম ৪ বলেই ম্যাচের ইতি! রূপকথা যেন বাস্তব হয়ে ফুটে উঠল কার্লোস ব্র্যাথওয়েটের ব্যাটে। ইডেন গার্ডেন্সে ইতিহাস গড়ল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 April 2016, 03:24 PM
Updated : 3 April 2016, 03:24 PM

শেষের তাণ্ডবে নায়ক ব্র্যাথওয়েট। তবে সেই মঞ্চটা গড়ে দেওয়ার নায়ক আরেক জন। যার হাত ধরে ফিরে এলো ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনাল; সেদিনের প্রেমাদাসা ফিরে এলো ইডেনে। সেবার ফাইনালে ৭৮ রানের দারুণ ইনিংসে দলকে এনে দিয়েছিলেন শিরোপা। এবার ৬৬ বলে ৮৫ রানের অসাধারণ এক ইনিংসে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল ভাগ্য গড়ে দিলেন মারলন স্যামুয়েলস।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের রোমাঞ্চকর ফাইনালে পার্থক্য গড়ে দিল স্যামুয়েলসের দুর্দান্ত ব্যাটিং আর ব্র্যাথওয়েটের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স। ইংল্যান্ডকে ৪ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা জিতল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০ ওভারে ৯ উইকেটে ১৫৫ রান তুলেছিল ইংল্যান্ড। বেন স্টোকসের শেষ ওভারে ব্র্যাথওয়েটের টানা চার ছক্কায় ক্যারিবিয়ানরা জিতে যায় ২ বল আগে।

একাধিকবার ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ী প্রথম দল ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পূর্বসূরিদের সেই কীর্তি স্পর্শ করল ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই দল। ছোট সংস্করণের বিশ্বকাপেও দুবার শিরোপা জয়ী প্রথম দল তারাই। দুটি বিশ্বকাপ জয়ে নেতৃত্ব দিয়ে একটা জায়গায় ক্লাইভ লয়েডের পাশে বসলেন ড্যারেন স্যামি।

হতাশায় মূহ্যমান ইংলিশদের জন্য ইডেন হয়ে থাকল দু:স্বপ্নই। ১৯৮৭ বিশ্বকাপের ফাইনালে ৭ রানে হারের পর এবারও হার খুব কাছে গিয়ে।

টান টান উত্তেজনার ফাইনাল পেন্ডুলামের মত দুলছিল শেষ ওভার পর্যন্ত। ৬ বলে ১৯ রানের সমীকরণে এগিয়ে ছিল হয়ত ইংল্যান্ডই। কিন্তু ক্যারিবিয়ানদের কাছে যে শেষের আগে শেষ নয় কিছুই! ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের যাবতীয় অনিশ্চয়তা, বুনো, খ্যাপাটে ব্যাপারটিই যেন সবটুকু সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দিল ওই শেষ ওভারে। স্কয়ার লেগ, লং অন, লং অফ ও মিড উইকেট, মাঠের চার প্রান্ত দিয়ে চারটি ছক্কায় ক্রিকেট বিশ্বের চারপাশ মাতালেন ব্র্যাথওয়েট।

শিরোপা জয়ের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দের ‘চ্যাম্পিয়ন্স ড্যান্স’। ছবি: রয়টার্স

৬৬ বলে অপরাজিত ৮৫ রান করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে শিরোপা জেতানোর পথে অসাধারণ সব শট খেলেন মারলন স্যামুয়েলস। ছবি: রয়টার্স

মাঠে বাধনহারা উল্লাসে মেতে উঠল ক্যারিবিয়ানরা। চলল ‘চ্যাম্পিয়ন ড্যান্স’। গ্যালারিতে উল্লাসে মাতল ওয়েস্ট ইন্ডিজের মেয়েরাও। ছেলেদের আগে ইতিহাস গড়েছে এই মেয়েরাও। টানা তিন বারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ক্যারিবিয়ান মেয়েরা জিতেছে প্রথম শিরোপা। সঙ্গে গত ফেব্রুয়ারিতে ক্যারিবিয়ান যুবাদের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয় কিছুটা হলেও মনে করিয়ে দেবে বিশ্ব ক্রিকেটে ক্যারিবিয়ানদের সেই পুরোনো দাপটকে।

স্যামুয়েলস-ব্র্যাথওয়েট না হয়ে ম্যাচের নায়ক হতে পারতেন জো রুট। ইংল্যান্ডের রান মেশিন ‘রুটিন’ মেনেই খেলেছেন দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। তবে আসল চমক দেখিয়েছেন তিনি বল হাতে।

ইংল্যান্ড অধিনায়ক ওয়েন মর্গ্যানকে ফেরানো স্যামুয়েল বদ্রিকে নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দের উচ্ছ্বাস। ছবি: রয়টার্স

দ্বিতীয় ওভারেই রুটকে বোলিংয়ে এনে সবাইকে চমকে দেন ওয়েন মর্গ্যান। ইংলিশ অধিনায়কের ফাটকা কাজেও লেগে যায় দারুণভাবে। অনিয়মিত বোলারকে দেখেই হয়ত চোখ চকচক করে উঠল চার্লস-গেইলদের। দুজনই মারতে গেলেন উড়িয়ে, দুই বিপজ্জনক ওপেনারই তিন বলের মধ্যে ধরা পড়লেন বেন স্টোকসের হাতে।

শুরুর ধাক্কা কাঁপিয়ে দিল সেমি-ফাইনালের নায়ককেও। অসাধারণ ইনিংস খেলে ভারতকে হারিয়ে দেওয়া লেন্ডল সিমন্স এবার আউট প্রথম বলেই। ১১ রানে নেই ৩ উইকেট!

তবে সেমি-ফাইনালে যিনি ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে, সেই স্যামুয়েলস ফাইনালে দাঁড়িয়ে গেলেন। শুরু থেকেই খেলেছেন কর্তৃত্ব নিয়ে। আরেক পাশে ডোয়াইন ব্রাভো সঙ্গ দিয়েছেন। ব্রাভো অবশ্য ডানা মেলতে সময়টা একটু বেশিই নিয়েছেন। ৭৫ রানের জুটিতে তাই লেগে যায় ৬৯ বল।

মাঝে হয়ে যায় এক দফা নাটকও। ২৭ রানে প্লাঙ্কেটের বলে উইকেটের পেছনে ধরা পড়ে ড্রেসিং রুমে ফিরেই যাচ্ছিলেন স্যামুয়েলস। কিন্তু থার্ড আম্পায়ার টিভি রিপ্লেতে দেখতে পান কিপার জস বাটলারের গ্লাভসে যাওয়ার আগে মাটি স্পর্শ করেছে বল। উইকেটে ফিরে আসেন স্যামুয়েলস। ম্যাচের ভাগ্যও যেন লেখা হয়ে গেল ওখানেই।

এক প্রান্তে উইকেট পড়েছে, ব্রাভো-রাসেল-স্যামিরা পারেননি সময়ের দাবি মেটাতে। আরেক প্রান্তে রান বাড়িয়ে গেছেন স্যামুয়েলস। সমীকরণ তবু চলে যাচ্ছিল ক্যারিবিয়ানদের নাগালের বাইরে। কিন্তু শেষের গ্ল্যাডিয়েটর সেই ব্র্যাথওয়েট, ১০ বলে অপরাজিত ৩৪!

শেষের মত ম্যাচের শুরুটাও ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের। নতুন বলে স্যামুয়েল বদ্রি নাড়িয়ে দিয়েছিলেন ইংলিশ ব্যাটিং। ম্যাচের দ্বিতীয় বলেই বদ্রির দারুণ এক স্লাইডারে ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে বোল্ড জেসন রয়।

পরের ওভারে আবারও দৃশ্যপটে বদ্রি। আন্দ্রে রাসেলের লেগ স্টাম্পে থাকা বাজে বলে টাইমিং দারুণ করেছিলেন অ্যালেক্স হেলস। কিন্তু শট ফাইন লেগে বদ্রিকে ফাঁকি দিতে পারেননি। জায়গায় দাঁড়িয়েই রিফ্লেক্স ক্যাচ নেন বদ্রি।

তৃতীয় উইকেটেও যথারীতি ছিলেন বদ্রি। এবার দারুণ এক গুগলিতে বিভ্রান্ত ইংলিশ অধিনায়ক ওয়েন মর্গ্যান। ১৯ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে তখন নড়বড়ে ইংল্যান্ড।

সেখান থেকে দারুণ খেলে ইংল্যান্ডের ইনিংস টেনে নেন জো রুট। মাঝে কিছুটা সঙ্গ দিয়েও ফিরে যান জস বাটলার (২২ বলে ৩৬)। রুট ফিফটি তুলে নেন ৩৩ বলে। তবে ৩৬ বলে ৫৪ করে বিদায় নেন তিনিও।

শেষ দিকে পিটার উইলির ছোটো কিন্তু কার্যকর ইনিংস (১৩ বলে ২১ রান) ও ক্রিস জর্ডানের অপরাজিত ১২ রান ইংল্যান্ডকে নিয়ে যায় দেড়শর ওপারে।

বদ্রির দারুণ শুরুর পর মাঝে দারুণ বোলিং করে ইংলিশদের থমকে দিয়েছিলেন ব্র্যাথওয়েট। টি-টোয়েন্টিতে আগের ৭ ম্যাচ মিলিয়ে নিয়েছিলেন ২ উইকেট; সেখানে ফাইনালেই ৪ ওভারে মাত্র ২৩ রান দিয়ে নিলেন ৩ উইকেট।

 

কে জানত, সেটি ছিল কেবলই সাফল্যের প্রথম অধ্যায়। ব্যাট হাতেও খেললেন ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস। ইংলিশদের স্তব্ধ করে ইডেনে বিজয় উৎসবে মাতল ক্যারিবিয়ানরা। উৎসবে ভাসছে হয়ত গোটা ক্যারিবিয়ান অঞ্চলই।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

ইংল্যান্ড: ২০ ওভারে ১৫৫/৯ (রয় ০, হেলস ১, রুট ৫৪, মর্গ্যান ৫, বাটলার ৩৬, স্টোকস ১৩, মইন ০, জর্ডান ১২*, উইলি ২১, প্লাঙ্কেট ৪, রশিদ ৪*; বদ্রি ২/১৬, রাসেল ১/২১, বেন ০/৪০, ব্রাভো ৩/৩৭, ব্র্যাথওয়েট ৩/২৩, স্যামি ১/১৪)।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ১৯.৪ ওভারে ১৬১/৬ (চার্লস ১, গেইল ৪, স্যামুয়েলস ৮৫*, সিমন্স ০, ব্রাভো ২৫, রাসেল ১, স্যামি ২, ব্র্যাথওয়েট ৩৪*; উইলি ৩/২০, রুট ২/৯, জর্ডান ০/৩৬, প্লাঙ্কেট ০/২৯, রশিদ ১/২৩, স্টোকস ০/৪১)।

ফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪ উইকেটে জয়ী

ম্যান অব দা ম্যাচ: মারলন স্যামুয়েলস

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জয়ীরা:

সাল

চ্যাম্পিয়ন

রানার্সআপ

২০০৭

ভারত

পাকিস্তান

২০০৯

পাকিস্তান

শ্রীলঙ্কা

২০১০

ইংল্যান্ড

অস্ট্রেলিয়া

২০১২

ওয়েস্ট ইন্ডিজ

শ্রীলঙ্কা

২০১৪

শ্রীলঙ্কা

ভারত

২০১৬

ওয়েস্ট ইন্ডিজ

ইংল্যান্ড