শান্ত-সুস্থির ও পরিণত এই তামিম

টি-টোয়েন্টিতে এখন নিজের সহজাত ঘরানার বাইরে এসে ভিন্ন ধরনের ব্যাটিং করছেন তামিম ইকবাল। বিপিএল-পিএসএলের পর এবার জাতীয় দলেও সাফল্য পেলেন এভাবে ব্যাটিং করে। অসাধারণ এক ইনিংসে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের জয়ের নাযক তামিমই।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিধর্মশালা থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 March 2016, 04:51 PM
Updated : 5 Oct 2016, 02:09 PM

তামিমের ইনিংসটির প্রসঙ্গ উঠতেই পিটার বোরেনের ঠোটের কোণে খেলে গেল এক চিলতে হাসি। যেভাবে তিনি চিনতেন, সেই তামিম এবার নিজেকে মেলে ধরেছেন ভিন্ন চেহারায়! ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে নেদারল্যান্ডস অধিনায়ক বললেন, “তামিম ২০ ওভার খেললে তো অন্তত সেঞ্চুরি হওয়ার কথা!”

বোরেনের ধারণায় ভ্রান্তি নেই। ক্রিকেট বিশ্ব তামিমকে যেভাবে চেনে, তাতে ২০ ওভার খেললে বেশিরভাগ দিন সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে আরও কিছু দূর যাওয়ার কথা। কিন্তু সেভাবে খেলে সেঞ্চুরি তো বহু দূর, বলার মত রানও করতে পারছিলেন না তামিম।

কোচের পরামর্শে তাই বদলে ফেলেছেন নিজেকে। ধুমধাড়াক্কার টি-টোয়েন্টিতে তামিম আঁকড়ে নিয়েছেন ব্যাটিংয়ের মৌলিকত্বকে - শুরুতে সময় নেওয়া, উইকেট বোঝা, ইনিংসটা গড়ে তোলা, বাজে বলকে প্রাপ্য সাজা দেওয়া আর সময়-সুযোগমত হাত খোলা। গত বিপিএল থেকেই মূলত টি-টোয়েন্টিতে এভাবে ব্যাটিং করছেন তামিম। প্রথম পরীক্ষাতেও সফল হয়েছেন। পরে একইভাবে খেলে মাতিয়ে এসেছেন পাকিস্তান সুপার লিগ। এবার সেই ফর্ম বয়ে আনলেন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেও। যেটা তামিম চাইছিলেন খুব করে!

৫৮ বলে অপরাজিত ৮৩ রান করার পথে শট খেলছেন বাংলাদেশের জয়ের নায়ক তামিম ইকবাল। ছবি: বিসিবি ওয়েবসাইট

বুধবার পরিস্থিতি-পারিপার্শ্বিকতা ঠিক এরকম একটি ইনিংসই দাবি করছিল তামিমের কাছ থেকে। এই মাঠে ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচ। দলের ভাবনায় উইকেট ছিল গতিময় আর বাউন্সি, বাস্তবতা উপহার ছিল মন্থরতা। আরেক পাশ থেকে উইকেট পড়ছিল টপাটপ। পরিস্থিতি বলছিল, সময় নিয়ে লম্বা ইনিংস খেলার কথা। তামিমের টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং দর্শনও এখন সেটিই। তামিম মেলে ধরলেন শান্ত-সুস্থির, পরিণত ও সুন্দর ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী।

কয়েকটি ভাগে আলাদা করা যায় তামিমের ৮৩ রানের ইনিংসটিকে। ইনিংসের চতুর্থ ওভারে, তিন বল আগেই সৌম্য সরকারকে হারানোর পরও তেড়েফুড়ে একটা শট খেলেছিলেন তামিম। বিপদ হয়নি, তবে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে করণীয়টা বুঝে গেছেন। এরপর তামিম খেলেছেন আরও নিয়ন্ত্রিত, আঁটসাঁট ক্রিকেট। প্রথম চার মেরেছেন ৫ ওভার পেরিয়ে যাওয়ার পর! শট খেলেছেন নিশ্চিত হয়ে।

ভুল তবু করে ফেলেছিলেন আরও একবার। রোয়েলফ ফন ডার মারউইকে বেরিয়ে এসে ছক্কা মারার পরের বলে আবার একই চেষ্টা করেছিলেন। বাঁহাতি স্পিনারের দ্রুতগতির ইয়র্কার তামিম ব্যাটে পাননি, গ্লাভসে জড়াতে পারেননি ডাচ কিপারও। বেঁচে যাওয়ার পর আর কোনো ভুল করেন তামিম।

পঞ্চাশ ছোঁয়ার পর যখন হাত খুলতে শুরু করেছেন, এক ওভারেই বাংলাদেশ হারাল মাহমুদউল্লাহ ও মুশফিককে। আবার পরিকল্পনা বদলে তামিম করে গেলেন দায়িত্বশীল ব্যাটিং। জানতেন, শেষ ওভার পর্যন্ত উইকেটে তার থাকতেই হবে! তামিম এক প্রান্তে ছিলেন বলেই ২০ ওভারের আগে গুটিয়ে যায়নি বাংলাদেশ। তামিম ছিলেন বলেই শেষের দিকে ছক্কা মারার প্রেক্ষাপট পেয়েছিলেন মাশরাফি-সানিরা। কিংবা শেষ ওভারে তামিমের নিজের ছক্কা? ৮ রানের জয়ে শেষ পর্যন্ত অনেক অমূল্য হয়ে উঠেছে সেই ছক্কা।

মারকাটারি ঘরানার ব্যাটসম্যান বলে টি-টোয়েন্টিতে বরাবরই অতি আগ্রাসী হতে চেয়েছেন তামিম। তাতে হয়েছে হিতে বিপরীত। অনেক ভাবে ব্যাটিংয়ের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ার পর বেছে নিয়েছেন এখনকার ধরন। সফল পিএসএল মিশন শেষে দেশে ফেরার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তামিম বলেছিলেন, কোচের সঙ্গে পরামর্শ করেই এখন বদলে ফেলেছেন নিজেকে।

বুধবার ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনেও তামিম বারবার বললেন, টি-টোয়েন্টিতে এখন অস্থির না হয়ে সুস্থির থাকার চেষ্টা করেন। সেই চাওয়ার প্রতিফলন পড়ছে ব্যাটিংয়ে। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ থেকে সাফল্যটা বয়ে আনলেন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে।

মজার ব্যাপার হলো, এই শান্ত-সুস্থির তামিমের স্ট্রাইক রেট কিন্তু কমেনি! ব্যাটিংয়ের ধরনে ও শরীরী ভাষায় হয়ত সেই তেড়েফুড়ে খেলা বা আগ্রাসনের ছাপ নেই, কিন্তু কার্যকারিতায় তা ঠিকই বিধ্বংসী। ব্যাটসম্যানদের বধ্যভূমির বিপিএলে তার স্ট্রাইক রেট ছিল ১১৮.৭২, যা তার ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেটের চেয়ে বেশি। আর নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে এই ইনিংসে কঠিন উইকেটে দেখে শুনে খেলার পর স্ট্রাইক রেট ১৪৩.১০।

প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডস বলেই তামিমের ইনিংসটি এদিন অনেককে মনে করিয়ে দিয়েছে আরেকটি ইনিংসের কথা। তার চাচা আকরাম খান ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফিতে ডাচদের বিপক্ষে অসাধারণ এক ইনিংস খেলেছিলেন। বলা হয় বৃষ্টিবিঘ্নিত ওই ম্যাচে আকরামের ৬৭ রানের সেই ম্যাচ জেতানো ইনিংসটির ওপরই দাঁড়িয়ে আজকের বাংলাদেশের ক্রিকেট। সেটির সঙ্গে এই ইনিংস তুলনীয় নয় অবশ্যই, তবে এই ম্যাচের পরিস্থিতি-পারিপাশ্বির্কতা বিবেচনাতেই এটাও অমূল্য। নইলে শুরুতেই হয়ত মুখ থুবড়ে পড়ত বাংলাদেশের বিশ্বকাপ অভিযান।

সংবাদ সম্মেলনে বোরেনের কথাগুলি দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে তামিমের ইনিংসটাকে।

“সে খুবই সেন্সিবল ইনিংস খেলেছে। কন্ডিশনের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে নিয়েছে। তামিম ২০ ওভার খেললে সেঞ্চুরি করে ফেলার কথা। কিন্তু আজ সে একাই দলকে টেনেছে। আরেক পাশ থেকে নিয়মিত উইকেট হারানো ওর রান করায় প্রভাব ফেলেনি। অন্যদের কাছ থেকে সমর্থন বলতে গেলে পায়নি, কিন্তু দারুণ পরিণতবোধ দেখিয়েছে। ওর পরিণত ইনিংসটিই দলকে জিতিয়েছে।” 

‘সেন্সিবল’, ‘একার লড়াই’, ‘কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া’, ‘পরিণত’ - আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তামিমের ব্যাটিংয়ে এই বিশেষণগুলির উপস্থিতি বিরল বললেও কম বলা হয়। তবে এখন থেকে হয়ত নিয়মিতই দেখা যাবে শান্ত, পরিণত, সুন্দর এই তামিমকে।