এবার পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে দুজনের পথচলা শুরুর পালা। একই বাস্তবতা বাংলাদেশ যুব দলে তাদের সতীর্থদেরও।
চূড়ায় থেকে শেষ
২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিলেটে এক সঙ্গেই যুব ওয়ানডেতে অভিষেক শান্ত ও মিরাজের। শুরুটা আক্ষরিক অর্থেই ছিল শূন্য থেকে। ওপেন করতে নেমে কোনো রান না করেই আউট হয়েছিলেন শান্ত। বল হাতে মিরাজ ছিলেন উইকেটশূন্য।
শনিবার একসঙ্গেই শেষ হলো দুজনের যুব ওয়ানডে ক্যারিয়ার; সেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই, ফতুল্লায়। তিন বছরের পথচলা যখন থামল, শূন্য দিয়ে শুরু করা সেই দুজনই পৌঁছে গেছেন শীর্ষে। যুব ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি রান শান্তর, ৫৮ ম্যাচে ৩৭.৯১ গড়ে ১ হাজার ৮২০। ৫৬ ম্যাচে ২০.৯০ গড়ে ৮০ উইকেট নিয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট মিরাজের।
দেশকে শিরোপা জেতানোর স্বপ্ন দুটি বিশ্বকাপে থেকে গেছে অধরা। তবে ৩ বছর ধরে এই চেষ্টাতেই ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে দুজন উঠে গেছেন চূড়ায়। বাংলাদেশের যুব ক্রিকেট সিস্টেমের একটা বড় অবদান আছে অবশ্যই। বাংলাদেশের মত এত দীর্ঘ সময় ধরে অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে গড়ে তোলা, এত ম্যাচ খেলা আর কোনো দেশেই হয় না। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলি তো বটেই, যুব ওয়ানডে তুলনামূলক অনেক কম খেলে এমনকি ভারতও। যুব ওয়ানডেতে ৫০টি ম্যাচ খেলা তিন ক্রিকেটারই বাংলাদেশের। শান্ত-মিরাজের সঙ্গে বাংলাদেশের আগের যুব অধিনায়ক মাহমুদুল হাসান (৫৭)। তবে অন্য দেশগুলো ম্যাচ কম খেলায় তো শান্ত-মিরাজদের কিছু করার নেই। বরং দীর্ঘসময় ধরে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সেই দুজন উঠে এসেছেন চূড়ায়।
চূড়ায় উঠে উদ্যমী সবাই চাইবেন নিজেকে আরও ছাড়িয়ে যেতে। তবে মিরাজ-শান্তদের সামনে বাস্তবতা ভিন্ন। নতুন চূড়ায় উঠতে হলে আবার তাদের শুরু করতে হবে একদম তলানি থেকে। জগতটাই যে বদলে যাবে এবার! ছোটদের জগতকে পেছনে ফেলে তাদের বিচরণ শুরু হবে বড়দের জগতে।
আগের জগতের দারুণ সাফল্য নতুন জগতে সহায়ক শক্তি হয়ে থাকবে অবশ্যই। তবে সেটা কেবলই মানসিক শক্তি, আত্মবিশ্বাসের জ্বালানি। রান-উইকেটের হিসেবে আবার শান্ত-মিরাজদের শুরু করতে হবে শূন্য থেকেই।
পথটা পরিষ্কার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে জায়গা করে নেওয়া, নিয়মিত খেলা, পারফর্ম করা। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে দল খুঁজে পাওয়া, পারফর্ম করা। হাই পারফরম্যান্স ইউনিটে ঠাঁই করে নেওয়া। ‘এ’ দলে সুযোগ পাওয়া ও পারফর্ম করা। আর ঘরোয়া ক্রিকেটে সব জায়গায় পারফরম্যান্সের পুরস্কার, জাতীয় দল!
বাংলাদেশের বাস্তবতায় অবশ্য নতুন করে পথচলার শুরুটা অন্য দেশগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত সহজ ও মসৃণ। দেশে ফেরার পর ইংল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্রিকেটারদের পরের লক্ষ্য থাকবে কোনো কাউন্টি কিংবা ফ্র্যাঞ্চাইজি দলের ‘রুকি’ চুক্তিতে ঢোকা। তারপরও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মৌসুমে ২-৩টি ম্যাচে অন্তত সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা। সুযোগ মিললে পারফর্ম করে আস্তে আস্তে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া। এমনি ভারতেরও এই যুব দলের বেশিরভাগ ক্রিকেটারের কাছে রঞ্জি দলে জায়গা পাওয়াও এখনও স্বপ্ন। সেখানে যুব বিশ্বকাপে খেলা বাংলাদেশের ১৬ জনের ১২ জনই পেয়ে গেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের স্বাদ!
সামনের চ্যালেঞ্জ
পথচলার শুরুতে বাংলাদেশের যুবারা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও আসল চ্যালেঞ্জ অপেক্ষায় সামনে। ঘরোয়া ক্রিকেটে মিরাজরা যে সাফল্য পেয়েছেন, তাতে বড় অবদান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্যাম্পের। নিয়মিত অনুশীলনে থাকায় সবারই ফিটনেস ছিল দারুণ, ছিল একাগ্রতা এবং খেলার মধ্যে থাকার সুবিধা। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্রিকেটার হওয়ায় যুব দলই ছিল তাদের ভাবনার মূল জায়গা। জাতীয় লিগে খেলেছেন তারা বড়দের ক্রিকেটে খেলার রোমাঞ্চ নিয়ে, যেখানে হারানোর ছিল সামান্যই।
দেশে ক্রিকেটারের সংখ্যা ও পারফরমারের স্রোতও এখন যথেষ্টই প্রবল। অবারিত সুযোগ তাই মিলবে না, অপেক্ষায় থেকে থেকে হয়ত মিলবে টুকটাক সুযোগ। কাজে লাগতে হবে সেটিকেই। প্রতি পদক্ষেপেই কঠিন বাস্তবতাকে সামলে ধারাবাহিক পারফর্ম করে এগিয়ে যাওয়া হবে এই যুবাদের চ্যালেঞ্জ।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করায় সবচেয়ে বড় দায়িত্ব অবশ্যই তাদের নিজেদের। তবে বড় দায়িত্ব আছে দেশের ক্রিকেট পদ্ধতিরও। প্রতিভাগুলোকে ধরে রাখার দায়িত্ব, পরিচর্যা করার দায়িত্ব। শান্ত-মিরাজদের মতো বিশেষ প্রতিভার ক্ষেত্রে চাই বিশেষ মনোযোগ! খুব সতর্কতায় সামলানো।
শুধু এই দুজনই বা কেন! যুব ক্রিকেটের জগতটা সীমিত। বিকাশের বা নিজেকে মেলে ধরার সুযোগও তাই অনেকের পর্যাপ্ত হয় না। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে খুব ম্রিয়মান থেকে বড় পরিসরে নিজেকে উজ্জ্বল করে তোলা কিংবা নতুন করে চেনানোর নজির আছে অসংখ্য। কে জানে, বিশ্বকাপে সমালোচিত সাইফ হাসানই হয়ত একদিন হবে টেস্টে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে বড় নাম! মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনের ইচ্ছেমত ইয়র্ক করার সামর্থ্যে মুগ্ধ খোদ ইয়ান বিশপ। ভবিষ্যতে বাড়বে গতি, শক্ত হবে পেশি, উন্নতি হবে তার ব্যাটিংয়েও। একদিন সাইফুদ্দিনই হয়ত ব্যাটে-বলে স্লগ ওভারে হয়ে উঠবেন বাংলাদেশের ভরসা, ঘুচবে সত্যিকারের একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডারের অভাব। বিশ্বকাপে বিবর্ণ হলেও সাঈদ সরকারের শট খেলার যে সামর্থ্য, একদিন আন্তজাতিক ক্রিকেটে তিনিই হয়ত হবেন আলোচিত ‘বিগ হিটার!’
শান্ত-মিরাজরা সঠিক পথে থাকলে একদিন হয়ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও রান আর উইকেটের চূড়ায় থাকবে তাদের নাম। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচের একাদশ থেকে বাদ পড়া সাইফের ব্যাটেই এক দিন হয়ত টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ের চূড়ায় উঠবে বাংলাদেশ। যুব বিশ্বকাপের শিরোপা না জেতার হতাশা হয়ত তারা ভুলবেন বাংলাদেশকে সত্যিকারের বিশ্বকাপ জিতিয়ে।