পারল না বাংলাদেশ

থেমে গেল দেশের মাটিতে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যুব দলের স্বপ্নযাত্রা। প্রথমবার সেমি-ফাইনালে ওঠার সাফল্য দীর্ঘায়িত হলো না ফাইনাল পর্যন্ত। স্বাগতিকদের ৩ উইকেটে হারিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Feb 2016, 07:04 AM
Updated : 11 Feb 2016, 01:58 PM

মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে ৫০ ওভারে ২২৬ রান তুলেছিল বাংলাদেশ। রান তাড়ায় শেষ দিকে চাপে পড়েও ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতে যায় ৮ বল বাকি থাকতে।

২০০৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও ফাইনালে উঠেছিল দিনেশ রামদিন, রবি রামপল, লেন্ডল সিমন্সদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে ফিরে এলো ২০০৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের স্মৃতি। সেবার বিশ্বকাপের আগে ত্রিদেশীয় সিরিজে ইংল্যান্ডকে তিন বার হারিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু বিশ্বকাপে সেই ইংল্যান্ডের কাছেই হেরেছিল কোয়ার্টার-ফাইনালে। এবার বিশ্বকাপের ঠিক আগে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৩-০ তে হারিয়েছিল মিরাজরা। সেমি-ফাইনালে হারতে হলো সেই দলের কাছেই।

গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ার খুব কাছে চলে গিয়েছিল যে দলটি, সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সবাইকে চমকে দিয়ে উঠে গেল ফাইনালে। ম্যাচ জেতানো ইনিংস আর শেষের বাউন্ডারিতে দলকে ফাইনালে তুলে উল্লাসে মেতে উঠেন শামার স্প্রিঙ্গার, ডাগ আউট থেকে ছুটে আসে তার সব সতীর্থ। মাঠের নানা প্রান্তে মিরাজরা তখন হতাশায় নুইয়ে পড়েছেন।

রোববার শিরোপার মঞ্চে স্বাগতিকেরা এখন শুধুই দর্শক। এর আগে শনিবার তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলবে বাংলাদেশ।

টপ অর্ডারের আরেকটি ব্যর্থতায় শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের দিন। ক্যরিবিয়ান পেস তোপে  তারা ৫ উইকেট হারিয়ে বসে ১১৩ রানেই। খাদের কিনারা থেকে দলকে উদ্ধার করেন মেহেদি হাসান মিরাজ। টুর্নামেন্টে তৃতীয় অর্ধশতক করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, ষষ্ঠ উইকেটে মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনের সঙ্গে ৮৫ রানের জুটিতে দলকে এনে দেন ২২৬ রানের পুঁজি। রানটা লড়াই করার মতোই, কিন্তু প্রথম ২৫ ওভারে বাজে বোলিং আর ফিল্ডিংয়ে ম্যাচের লাগাম নিতে পারেনি বাংলাদেশ। পরে নিজেদের শুধরে চেষ্টা করেছে ফেরার, কিন্তু ততক্ষণে হয়ে বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

কৃতিত্ব দিতে হবে ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানদেরও। ওপেনার গিডরন পোপের ঝড়ে ৫ ওভারেই ৪৪ রান তুলে ফেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ইনিংস জুড়ে তাই কখনও রান রেটের চাপে পড়তে হয়নি ব্যাটসম্যানদের।

বড় ম্যাচে মাঝারি সংগ্রহের চাপেই কিনা, টুর্নামেন্টে অসাধারণ ফিল্ডিং করা বাংলাদেশ সেমি-ফাইনালে হঠাৎ করেই ভেঙে পড়ে। ২৩ রানে পোপের সহজ ক্যাচ ছাড়েন সালেহ আহমেদ শাওন গাজী। প্রথম ওভারেই মিরাজকে দুটি চার ও একটি ছক্কায় শুরু করেন পোপ। ব্যক্তিগত লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয়টা বাংলাদেশ অধিনায়কেরই হয়। পোপকে (২৫ বলে ৩৮) বোল্ড করে খ্যাপাটে উদযাপনে মাতেন মিরাজ। এর আগেই অবশ্য টেভিন ইমলাখকে (১৪) ফিরিয়ে দলকে প্রথম ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছিলেন অধিনায়ক।

সেই চাপটাকে পেয়ে বসতে দেয়নি ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানরা। কিস কার্টিকে নিয়ে তৃতীয় উইকেটে ৬২ রানের জুটি গড়েন অধিনায়ক শিমরন হেটমায়ার। বাংলাদেশের বোলারদের আলগা বোলিংকে কাজে লাগিয়ে দলের রান বাড়ান দুজন।

বিস্ময়কর ভাবে টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সেরা বোলার সাইফুদ্দিকে ১ ওভার করিয়ে আর বোলিংয়ে আনছিলেন না মিরাজ। শেষ পর্যন্ত ২৮তম ওভারে বল হাতে পেয়ে সাইফুদ্দিনই ফেরান হেটমায়ারকে (৬০)।

শাওন গাজী পরে এক ওভারে দুটি উইকেট নিয়ে জমিয়ে দিয়েছিলেন ম্যাচ। কিন্তু বাংলাদেশের সামনে বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়ান শামার স্প্রিঙ্গার। বল হাতে ২ উইকেট নেওয়ার পর ব্যাট হাতে প্রচণ্ড চাপের মাঝে ৬২ রানের অসাধারণ অপরাজিত ইনিংস, ম্যাচসেরায় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না স্প্রিঙ্গারের।

ক্যারিবিয়ানদের জয়ের ভিত্তি অনেকটা গড়া হয়ে গিয়েছিল ম্যাচের প্রথম ইনিংসেই। ক্যারিবিয়ান পেসাররা নিজেদের পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিতে সময় নেননি একটুও। ম্যাচের প্রথম বলেই আলজারি জোসেফের বাউন্সার উড়ে যায় পিনাক ঘোষের মাথার ওপর দিয়ে। গতি আর আগ্রাসন দিয়ে টুর্নামেন্টের আলোচিত এই ফাস্ট বোলার প্রথম ওভারে ৫টিই করেন শর্ট বল। একটি শর্ট বলে হেলমেটে লাগিয়ে নাড়িয়ে দেন পিনাককে।

শর্ট বলে স্রোতে নড়বড়ে হয়েই কিনা, পিনাক আউট হন বাজে এক বলে। শেমার হোল্ডারের অফ স্টাম্পের বাইরের শর্ট বল পাঠিয়ে দেন থার্ডম্যানের হাতে! যুব ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে দেড়শ’ রানের ইনিংস খেলা একমাত্র ব্যাটসম্যান এই বিশ্বকাপের ৫ ম্যাচে ৩ বারই আউট হলেন শূন্য রানে!

ব্যর্থতার বলয় থেকে বের হতে পারেননি আরেক ওপেনার সাইফ হাসানও। জোসেফের শর্ট বলে পুল করতে গিয়ে একটু দেরি করে ফেলেছিলেন, ধরা পড়েন শর্ট স্কয়ার লেগে (১০)।

জোড়া ধাক্কার পরও প্রথম ১০ ওভারে রান ছিল ২ উইকেটে ৪৮। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সেরা শুরু! আগের ৪ ম্যাচে প্রথম ১০ ওভারে রান ছিল যথাক্রমে ৩৭, ১৯, ৩৮ ও ২১।

সকাল ৯টায় শুরু ম্যাচে প্রথম ১০ ওভার নিয়েই ছিল শঙ্কা। কিন্তু সে সময়টা মোটামুটি উতরে গিয়েও বাংলাদেশ গড়বড় করে পরে। একের পর এক ব্যাটসম্যান ফেরেন বাজে শটে। অফ-মিডলে থাকা বল ফ্লিক করতে গিয়ে আউট হন দলের সেরা ব্যাটসম্যান নাজমুল হোসেন শান্ত (১১)। আরও একবার থিতু হয়েও উইকেট ছুঁড়ে এসেছেন জয়রাজ শেখ (৩৫)। হোল্ডারকে ক্রস ব্যাটে উড়িয়ে মারতে গিয়ে স্টাম্প হারান জাকির (২৪)।

এরপরই মিরাজ-সাইফুদ্দিনের জুটি। প্রথম ৩০ ওভারে স্পিন আনেননি ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক শিমরন হেটমায়ার। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বোলিং করান প্রথম চার পেসারকেই। আরেক পেসার কিমো পল ফিল্ডিংয়ে চোট পেয়ে ওই সময় বোলিং করতে না পারায় বিপাকে পড়েন ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক। স্পিন আক্রমণে আসায় স্বচ্ছন্দে খেলতে থাকেন বাংলাদেশের দুই ব্যাটসম্যান।

থিতু হওয়ার পর পেসারদের বিপক্ষেও দারুণ খেলেছেন দুজন। সিঙ্গেল-ডাবলস নেওয়ার ফাঁকে বাজে বলকে দিয়েছেন প্রাপ্য সাজা। চোট কাটিয়ে বল হাতে নিয়েই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থমকে দেন কিমো পল। ৪৬তম ওভারে পরপর দু বলে দুই থিতু ব্যাটসম্যানকেই ফিরিয়ে দেন এই মিডিয়াম পেসার।

টুর্নামেন্টে তৃতীয় অর্ধশতকের পর শর্ট বল আকাশে উড়িয়ে ধরা পড়েন মিরাজ। পরের বলেই ডাউন দা উইকেটে খেলে লাইন মিস করে বোল্ড সাইফুদ্দিন (৩৬)। পরের ওভারে পল ফিরিয়ে দেন সাইদ সরকারকেও (২)। শেষ ২৮ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ২২৬ রানে থমকে যায় বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের বোলিং শক্তি বিবেচনায় রানটাকে তখন খারাপ মনে হয়নি। কে জানত, এই দিনটিতেই সবচেয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠবে দলের বোলিং-ফিল্ডিং!