কেউ মনে রাখেনি সেতুকে

খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে একটি স্ট্যান্ড আছে মানজারুল ইসলাম রানার নামে। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া জাতীয় দলের এই ক্রিকেটার বেঁচে আছেন স্মৃতিকথা, আলোচনা আর আবেগে। কিন্তু কেউ মনে রাখেনি সাজ্জাদুল হাসান সেতুকে। সত্যিই যেন হারিয়ে গেছেন রানার সঙ্গেই পরপারে চলে যাওয়া এই ক্রিকেটার।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Jan 2016, 04:33 AM
Updated : 28 Oct 2016, 11:47 AM

বাড়ির নাম ‘সেতু’

খুলনা শহরের বাগমারা প্রাইমারি স্কুল রোড; বাড়ির নাম ‘সেতু’। বাড়ির সবচেয়ে বড় পরিচয়ও এটিই, সেতু।

গেট খোলাই ছিল, ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই এগিয়ে এলেন একজন প্রৌঢ়া। ‘এটা কি সেতুদের বাড়ি?’ প্রশ্নটি যেন প্রচণ্ড এক ধাক্কায় কাঁপিয়ে দিল মানুষটিকে। মুহূর্তেই তার চোখে জল, ‘সেতু…আমার সেতু’ বলতে বলতে অস্থির হয়ে ঢুকে পড়লেন বাড়ির ভেতরে। ঘটনার আকষ্মিকতায় হতভম্ব আগন্তুক কজন সংবাদকর্মী!

বাড়ির নাম সেতু; কিন্তু নামটি খুব সচেতনভাবেই উচ্চারণ করা হয় না এই বাড়িতে। ‘সেতু’ নামটি যে হাহাকার জাগায়; সেটির ধাক্কা যে সইতে পারেন না ওই প্রৌঢ়া, গোলেনাহার বেগম!

ছেলে হারানোর নিত্য বেদনা অনেক কষ্টে চেপে রাখেন মনের কোনো এক প্রকোষ্ঠে। কিন্তু কেউ প্রসঙ্গটি তুললেই খুলে যায় সেই প্রকোষ্ঠের দ্বার, দু:সহ যন্ত্রণা আবারও গ্রাস করে নেয় তাকে। একদমই সইতে পারে না গোলেনাহার বেগমের জরাগ্রস্ত শরীর। অতিথিদের সেতুর কক্ষে বসতে দিয়ে কাঁদতে থাকেন অঝোরে।

কক্ষে একটি আলমারিতে সাজানো সেতুর স্মৃতি হয়ে থাকা অনেক ট্রফি, মেডেল, স্মারক। আলমারির ঠিক ওপরেই সেতুর হাস্যোজ্জ্বল ছবি। সদাহাস্য মানুষটি ২০০৭ সালের ১৬ মার্চ থেকে এভাবেই হয়ে গেছেন ছবি।

২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ত্রিনিদাদে বাংলাদেশ দল যখন নিজেদের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামার অপেক্ষায়, বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গন তখন স্তব্ধ একটি দু:সংবাদে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন তরুণ দুই ক্রিকেটার, মানজারুল ইসলাম রানা ও সাজ্জাদুল হাসান সেতু।

সর্বনাশা যাত্রা

আগের দিনই ফতুল্লায় জাতীয় লিগের ম্যাচে ঢাকা বিভাগের বিপক্ষে খুলনার হয়ে মাঠে নেমেছিলেন রানা ও সেতু। রানা তখন খুলনার অধিনায়ক, সেতু নির্ভরযোগ্য টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। চার  দিনের ম্যাচ শেষ করে রাতেই খুলনা ফিরে পর দিন দুজনে খেলেছেন স্থানীয় একটি ম্যাচ।

ম্যাচ শেষে কিটব্যাগ রিকশায় তুলে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হন সেতু। পেছন থেকে ডাকেন খুলনা দলেরই সতীর্থ, বাংলাদেশের হয়ে দুটি টেস্ট খেলা উইকেটকিপার মোহাম্মদ সেলিম, ‘সেতু, চল আব্বাসের হোটেল থেকে খেয়ে আসি।’ সেতুর মনটা সায় দেয় না, ‘নারে, মা খাবার নিয়ে বসে আছে, তোরা যা।’ সেলিম-রানারা তবু জোর করেন, ‘চল, বেশি দেরি হবে না।’

বন্ধুদের আর উপেক্ষা করতে পারেন না সেতু। এই রিকশাতেই কিটব্যাগ পাঠিয়ে মাকে খবর পাঠিয়ে দেন, ‘মাকে গিয়ে বলিস খেয়ে নিতে। রাতে ফিরে একসঙ্গে খাব।’ একটি মোটরসাইকেলে সেলিম ও সেতু, আরেকটি মোটরসাইকেলে রানা ও আরেক ক্রিকেটার শাওন, চারজনে চললেন খুলনার অদূরেই চুকনগরে বিখ্যাত আব্বাস হোটেলের খাসির মাংসের টানে। কে জানত, সেটিই হবে শেষ যাত্রা।

বাইকে পেছনে বসে রানার সঙ্গে বারবার খুনসুটি করছিলেন শাওন। বিরক্ত রানা মাঝ পথে গিয়ে শাওনকে সেলিমের বাইকে পাঠিয়ে নিজের মোটরসাইকেলে নিয়ে আসেন সেতুকে। এক পর্যায়ে সেলিম ও শাওন অনেকটা এগিয়ে গিয়েও পেছনে রানাদের দেখতে না পেয়ে আবার ফিরে আসে পেছন দিকে। পথেই দেখতে পান তারা মর্মান্তিক সেই দৃশ্য। রাস্তায় পড়ে আছে রানা ও সেতুর রক্তাক্ত শরীর। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু।

পুরো ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন সেতুর প্রতিষ্ঠিত ‘পপুলার প্লাস’ সংগঠনের একনিষ্ঠ এক সদস্য মো: হাশেম আলি। সেতুর ঘনিষ্ঠ এই সঙ্গী জানালেন, সম্ভবত দ্রুতগতির একটা অ্যাম্বুলেন্স ধাক্কা দিয়েছিল রানা-সেতুর মোটরসাইকেলকে। মাথায় আঘাত পেয়ে মৃত্যু হয় সেতুর।

রানার বয়স ছিল ২৩ বছর ছুঁইছুঁই, সেতুর ২৮।

ক্রিকেট মাঠের সেতু

জাতীয় দলে কখনো খেলা হয়নি সেতুর। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে এই ডান হাতি ব্যাটসম্যান ছিলেন মোটামুটি পরিচিত নাম। মৃত্যুর আগের দিন জাতীয় লিগের যে ম্যাচটি খেলেছিলেন, প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারে সেটি ছিল তার ৫০তম ম্যাচ। ৩টি শতক ও ১২টি অর্ধশতকে রান করেছিলেন ২ হাজার ৪৪৩। ৩৯টি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে ১টি শতক ও ২টি অর্ধশতকে ৬৮০ রান।

ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটেও খেলেছেন নিয়মিতই। খেলেছেন ধানমণ্ডি ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, সিটি ক্লাবে।

ভুলে যাওয়া নাম ও এক মায়ের জীবন যুদ্ধ

৬ টেস্ট ও ২৫ ওয়ানডে খেলা মানজারুল ইসলাম রানার জন্যই বাংলাদেশ ক্রিকেটের হাহাকার স্বাভাবিকভাবেই ছিল বেশি। তবে ছেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার ছিল কিনা, একজন মায়ের কাছে তো আর সেই বিবেচনা নেই। শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম ঘেষেই মুজগুন্নিতে রানার বাড়ির শোক যখন ছুঁয়ে গেছে গোটা দেশকে, অদূরেই বাগমারায় সেতুর বাড়িতে মাতম তখন আড়ালেই রয়ে গেছে অনেকটা।

শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে গোলেনাহার বেগম আক্ষেপ করেন, “এই যে খেলা চলছে, আমি জানি। যখনই খেলা-টেলা হয়, সবই জানি। আমার ভেতরটা কেঁদে ওঠে। অনেক সময়ই রানাদের বাড়িতে অনেকে আসে, আমি জানি, খবর পাই। আমার বাড়ি কি খুব দূরে? কেউ আসে না।”

ডুকরে কাঁদতে থাকেন অসহায় এক মা। কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপেই বলতে থাকেন নিজের জীবন যুদ্ধের কথা। সন্তান হারানোর বছর দুয়েকের মধ্যে হারান তিনি স্বামীকেও। ক্রিসেন্ট জুট মিলের ক্যাশিয়ার ছিলেন সেতুর বাবা আব্দুল মতিন সরকার। ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধে হার মানেন ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে।

দুই ভাই ছিলেন সেতুরা। বড় ভাই মাসুদুল হাসান মিতুও ক্রিকেট খেলতো। খুলনার স্থানীয় লিগে দাপটে খেলেছেন, ঢাকায় খেলেছেন প্রথম বিভাগ ক্রিকেটও। ২০০৫ সালের দিকে জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমান ইতালিতে। তবে সেখানে থিতু হতে তাকে লড়াই করতে হয়েছে অনেক। সংসারটা টানতেন তাই বলতে গেলে সেতুই। উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে পরিবার পড়েছিল অথৈ সাগরে।

সেতুর মৃত্যুর পরপর কিছু অনুদান মিলেছিল। সেতুর স্ত্রী পেয়েছিলেন সেই অনুদান। সেতুকে হারানোর পর তিনিও বিয়েথা করে বেছে নিয়েছেন নতুন জীবন। সেতুদের পরিবারকে লড়াই করতে হয়েছে টিকে থাকতে।

একটু আকুতি

সন্তান হারানোর কষ্ট, জীবন যুদ্ধ-সব মিলিয়ে গোলেনাহার বেগমের শরীরে বাসা বেধেছে নানা রোগ। ঢাকায় এসে হার্টের অস্ত্রোপচার করেছেন এক দফা। তাতেও ঠিক হয়নি। গত কিছুদিন হলো ইতালিতে পায়ের নিচে কিছুটা জমি খুঁজে পেয়েছেন বড় ছেলে মিতু। মাকে তাই ইতালিতে নিয়ে গিয়ে হার্টের অস্ত্রোপচার করিয়েছেন আরেক দফা। মাকে রাখতে চেয়েছিলেন ইউরোপে। কিন্তু সেতুর স্মৃতি ছেড়ে দূরদেশে থাকতে রাজি নন মা, ফিরে এসেছেন দেশে। নানা অসুখ আর ঔষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শ্রবণশক্তিও হারিয়েছেন অনেকটা। তবে একটা শব্দ তিনি সব সময়ই বুঝে ফেলেন, ‘সেতু!’

সেতুর প্রতিষ্ঠিত ‘পপুলার প্লাস’ সংগঠনটির অস্তিত্বও প্রায় নেই এখন। হাল ধরে রেখেছেন ওই কাছের ছোট ভাই হাশেম মিয়া। তিনি জানালেন, রানার নামে খুলনা স্টেডিয়ামে একটি স্ট্যান্ড নামকরণ করার পর তাদের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল সেতুর নামেও একটি স্ট্যান্ড বা কিছু একটি করার। কিন্তু জাতীয় দলে কখনও খেলেননি যুক্তিতে সেই অনুরোধ রাখেনি বিসিবি।

শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে ঢুকতেই দেয়ালে ছবির যে ডিসপ্লে বোর্ড, সেখানে অবশ্য খুলনার অকালপ্রয়াত ক্রিকেটর-কোচ শেখ সালাউদ্দিন, রানার সঙ্গে ঠাঁই পেয়েছেন সেতুর হাসিমুখের ছবিও। প্রতিবছর মৃত্যুবার্ষিকীতে রানার সঙ্গে সেতুকেও খানিকটা স্মরণ করা হয়, টুটপাড়ায় কবরস্থানে দেওয়া হয় ফুল। সেতু টিকে আছেন স্রেফ এইটুকুতেই।

অস্ফুট স্বরে সেতুর মা বলতে থাকেন, “একটা গ্যালারি না হোক, মাঠে কিছু একটার নামকরণ করা যায় সেতুর নামে। কিছু না হলে অন্তত বাড়ির পাশের রাস্তাটি তো সেতুর নামে করা যায়।”

কিছু একটার নামকরণ করা তো বহুদূর, কেউ মনে রাখেনি সেতুকে। হাবিবুল বাশার, আতহার আলি খানরা এসেছেন একসময় টুকটাক। সেটাও এখন অতীত। সেতুর পরিবারের খোঁজ কেউ রাখে না। সব মিলিয়ে দু:খ, হতাশায় অসুস্থ গোলেনাহার বেগমের বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাও মরে যাচ্ছে প্রতিদিন।

ভারী মন নিয়ে বের হয়ে আসার সময় আবারও ডুকরে কেঁদে ওঠেন সেতুর মা, ‘আপনারা তো তবু দেখতে এলেন, কতদিন পর কেউ এল। এ রকম কেউ কেউ যদি মাঝেমধ্যে আসতো, হয়ত আর কটা দিন বেশি বেঁচে থাকতাম।”