মুগ্ধতা ছড়াচ্ছেন আবু হায়দার

এবারের বিপিএলে বাংলাদেশের উঠতি ক্রিকেটারদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছেন আবু হায়দার রনি। তরুণ বাঁহাতি এই পেসারকে কাছ থেকে দেখে মুগ্ধ মাশরাফি বিন মুর্তজাও।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Dec 2015, 06:59 AM
Updated : 1 Dec 2015, 07:37 AM

শেষ ওভারে প্রয়োজন মাত্র ৪ রান, হাতে ৬ উইকেট। উইকেটে থিতু হয়ে যাওয়া এক ব্যাটসম্যান। সহজ জয়ের পথে সিলেট সুপার স্টার্স। হঠাৎই অনিশ্চয়তা আর শঙ্কায় সিলেটের ড্রেসিং রুম কাঁপিয়ে দিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের তরুণ পেসার রনি। টানা দুই বলে ফিরিয়ে দিলেন অর্ধশত করা রবি বোপারা ও লঙ্কান ব্যাটসম্যান শিহান জয়াসুরিয়াকে!

শেষ পর্যন্ত জেতাতে পারেননি কুমিল্লাকে; তবে আরও একবার নিজেকে চিনিয়েছেন। জানান দিয়েছেন নিজের সম্ভাবনার। এবারের বিপিএলে বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটারদের মধ্যে এখন পর্যন্ত উজ্জ্বলতম নাম তাই আবু হায়দার রনি।

সোমবার দলের হেরে যাওয়া ম্যাচে ২৮ রানে ৪ উইকেট পেয়েছেন এই বাঁহাতি পেসার। আগের আরও তিন ম্যাচে পেয়েছেন দুটি করে উইকেট। একটি ম্যাচে কেবল ছিলেন উইকেটশূন্য। সব মিলিয়ে ৫ ম্যাচে ১০ উইকেট। চট্টগ্রাম পর্বের প্রথম দিন শেষে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে যৌথভাবে এবারের বিপিএলের সর্বোচ্চ উইকেট তার। ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন মাত্র ৬.৩৫।

বিপিএল শুরুর আগে আলোচনায় ছিলেন সামান্যই। কিন্তু শুরুর প্রথম সপ্তাহে মাঠের ক্রিকেটে সবচেয়ে আলোচিত নাম সম্ভবত ১৯ বছর বয়সী এই পেসারই।

সংখ্যার চেয়েও বেশি কিছু

পরিসংখ্যানে প্রতিফলন হয়েছে তার পারফরম্যান্সের। তবে স্রেফ সংখ্যার বাইরেও আছে আরও অনেক কিছু যা চেনায় তার প্রতিভা, সামর্থ্য ও টেম্পারামেন্টকে।

একজন তরুণ ক্রিকেটারকে বিচার করার জন্য টি-টোয়েন্টি আদর্শ আঙিনা নয় অবশ্যই। মাত্র ৫টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ তো যথেষ্ট নয়ই কাউকে পড়ে ফেলার জন্য। তবে এরই মধ্যে নজর কাড়ার মত অনেক কিছু করে ফেলেছেন আবু হায়দার রনি।

বলে তুমুল গতি না থাকলেও বাংলাদেশের পেসার বিবেচনায় যথেষ্টই গতিময় রনি। সহজাত লেংথ দারুণ। নিজের সেই লেংথে ক্রমাগত বল ফেলেও যেতে পারেন। বাঁহাতি পেসারের সহজাত অ্যাঙ্গেল তো আছেই, আছে সুইং করানোর সামর্থ্যও। ভেতরে ঢোকানো এখনও ততটা রপ্ত করতে পারেননি। তবে আছে দারুণ এক ইয়র্কার। বরিশাল বুলসের বিপক্ষে দেরিতে সুইং করে ভেতরে ঢোকা ইয়র্কারে যেভাবে বোল্ড করেছেন মাহমুদউল্লাহকে, সেই ডেলিভারি তৃপ্তি দিত এমনকি সেরা ফর্মের ওয়াসিম আকরাম, চামিন্ডা ভাস বা হালের মিচেল স্টার্ককে। রনির স্লোয়ার বলটাও বেশ ভালো।

তার আরও বড় সম্পদ মানসিকতা, টেম্পারামেন্ট। ফাস্ট বোলারদের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় বুনো, খ্যাপাটে ব্যাপারটির ছোঁয়া আছে তার মাঝে। বোলিংয়ের ধরন, উদযাপন ও মানসিকতায় যথেষ্টই আগ্রাসী। সোমবারের ম্যাচে দেখিয়েছেন হারার আগে হার না মানার মনোভাব। সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ ফাস্ট বোলার হয়ে ওঠার প্রায় সব রসদই মজুদ।

তরুণ পেসারকে মনে ধরেছে মাশরাফিরও। সোমবার সিলেটের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স অধিনায়ক জানালেন তার মুগ্ধতার কথা।

“রনি খুবই ইমপ্রেসিভ। তবে এখনও বয়স কম। যদি নিজেকে সামলে রাখতে পারে, ওর সামনে অনেক উজ্জ্বল ভবিষ্যত। আর এই মুহূর্তে দারুণ উপভোগ করছে ও। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”

১০ রানে ৯ উইকেট!

বিপিএলের ম্যাচ টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। এখানে গ্ল্যামারও বেশি, আমজনতা থেকে সংবাদমাধ্যম, সবারই দৃষ্টি কাড়া যায় দ্রুত। এজন্য বিপিএলের পারফরম্যান্সেই অনেকে চিনছেন আবু হায়দারকে। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক ক্রিকেটেরই ফসল। খেলেছেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯ দলে!

আলাদা করে প্রথম নজর কেড়েছেন সম্ভবত ২০১২ সালে জুনে এসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্টে। মালেয়েশিয়ায় সেবার কাতারের বিপক্ষে যে ম্যাচে ১৩৫ বলে ২০৯ রান করেছিলেন সৌম্য সরকার, সেই ম্যাচেই ৫.৪ ওভার বোলিং করে ১০ রানে ৯ উইকেট নিয়েছিলেন ১৬ বছর বয়সী আবু হায়দার! বাংলাদেশের ৩৬৩ রানের জবাবে ৩৫ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল কাতার।

পরের বছর একই টুর্নামেন্টে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন আবার। এবার আবুধাবিতে মালেয়েশিয়াকে ৫০ রানে গুটিয়ে দিল বাংলাদেশ। আবু হায়দারের বোলিং ফিগার ৮-৪-৮-৫!

২০১২ ও ২০১৪ যুব টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলেছেন। বিশ্ব আসরে অবশ্য সেভাবে নজর কাড়তে পারেননি। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে নজর কাড়ার মত পারফর্ম করেছেন বিপিএলের আগেও। বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ফাস্ট বোলারদের কাজটা কঠিন। ১১ ম্যাচে আবু হায়দারের ১৮ উইকেটেও সেটিরই প্রতিফলন। তবে লিস্ট ‘এ’-তে আবির্ভাবেই নিজেকে জানান দিয়েছেন। গত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ভিক্টোরিয়ার হয়ে নিয়েছিলেন ১৭ উইকেট।

ভিক্টোরিয়ার পর এবার জ্বলে উঠলেন ভিক্টোরিয়ান্সের হয়েও।

সম্ভাবনার হাতছানি

বাইরে থেকে অনেকে যা দেখছেন, মাঠ আর ড্রেসিং রুমে থেকে কাছ থেকে সেটা আরও ভালো করে উপলব্ধি করছেন মাশরাফি। ম্যাচের শুরুতে-মাঝে-শেষে, যে কোনো পরিস্থিতিতেই কুমিল্লা অধিনায়কের ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছেন তরুণ এই পেসার।

বাংলাদেশ অধিনায়কের মনে ভালোভাবেই জায়গা করে নিয়েছেন আবু হায়দার।

“অনেক কিছুই ভালো ওর। প্রথম থেকেই ইয়র্কার মারতে চায়। মানে সেই আত্মবিশ্বাস ওর আছে। স্লোয়ার খারাপ না। লেংথ বলও ভালো ওর, জায়গায় বল করতে পারে। পেসও ডিসেন্ট। এই বয়সে এতগুলো স্কিল থাকা মানে আরও কাজ করলে ২-১ বছর পরে আরও খুব ভালো বোলিং করবে।”

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা তো আছেই। দীর্ঘ পথচলায় মাশরাফির আছে আরও অনেককে দেখার অভিজ্ঞতা, বোঝেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাস্তবতাও। আবু হায়দারের সম্ভাবনার কথা বলার পাশাপাশি প্রতিবারই মাশরাফি তাই যোগ করে দিচ্ছেন, সঠিক পথে থাকার শর্ত।

“যেটা বললাম, নিজেকে যত্ন করলে ও সামলাতে পারলে অনেক দূর যেতে পারবে রনি। ওর ভেতরে এমনিতেই অনেক কিছু আছে, যা খুব ভালো। সেসবে উন্নতি করতে পারলে ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে।”

বলার অপেক্ষা রাখে না, আবু হায়দার এখনও কেবল একটি কুঁড়ি। একদমই হাঁটি হাঁটি পা পা করছেন, পথচলার শুরুও সেভাবে হয়নি। যত্ন-আত্তি করে, সঠিক পথে রেখে এই কুঁড়িকে সৌন্দর্যময় এক ফুল হয়ে ফোটানোর দায়িত্ব যেমন রনির নিজের, দায়িত্বটা তেমনি বাংলাদেশ ক্রিকেটেরও।