সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্বে থাকছে নিজের নেতৃত্ব আর দলের তরুণদের নিয়ে মাশরাফির মূল্যায়ন।
বাংলাদেশের সাফল্য যাত্রায় সিনিয়রদের পাশাপাশি তরুণদের অবদানের কথা বলেছেন আপনি। ওদের নিয়ে যদি আলাদা করে জানতে চাওয়া হয়, শুরুতে সৌম্য সরকার…
তবে এখনও অনেক নতুন। আমাদের দেশে অনেক ক্রিকেটার শুরুতে অনেক ভালো করে। পরে যখন প্রতিপক্ষ তাদের নিয়ে কাটাছেঁড়া শুরু করে, তখন আর পেরে ওঠে না। সৌম্য শুরুতেই যেসব দলের বিপক্ষে সাফল্য পেয়েছে, বিশ্ব ক্রিকেটে যেভাবে নজর কেড়েছে, সব দলই ওখন ওর ব্যাটিং বিশ্লেষণ করবে। এখনই ওর আসল চ্যালেঞ্জ শুরু।
এখন দেখার ব্যাপার হলো, সৌম্য কিভাবে নিজেকে গড়ে তোলে। প্রাথমিকভাবে ওর যেটা দরকার ছিল, দলে জায়গা পাকা করা, সেটা ও পেয়ে গেছে। এখন নিজেকে গড়ে তোলার পালা।
আরেক তরুণ, মুস্তাফিজের বোলিং নিয়ে তো আরও বেশি কাটাছেঁড়া হবে। কাটার-স্লোয়ার সবই হাত দেখে পড়ার চেষ্টা করবে ব্যাটসম্যানরা।
মাশরাফি: আমি বিশ্বাস করি, মুস্তাফিজের বোলিং অ্যানালাইসিস করেও খুব বেশি লাভ নেই। হয়ত সাবধানে খেললে উইকেট কম দেওয়া যাবে ওকে, তবে রান নেওয়া কঠিন। আমার ‘গাট ফিলিং’ যেটা বলে, মুস্তাফিজ এই মুহূর্তে বিশ্বের এক নম্বর ওয়ানডে বোলার। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ও যদি ঠিক পথে থাকে, তাহলে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব ক্রিকেট ওকে অন্যরকমভাবে মনে রাখবে। ওর জন্য বাংলাদেশের ক্রিকেটের অনেক সুনাম হবে, অনেক গৌরব বয়ে আনবে।
ওর যা সামর্থ্য, তাতে বিশ্বের সব বড় বড় বোলারের রেকর্ড সে ভাঙতে পারবে। ওর জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট অনেক এগিয়ে যাবে, লিখে রাখতে পারেন।
এবং লিটন দাস, আপনি যাকে খুব উঁচু মূল্যায়ন করেন সব সময়।
মাশরাফি: লিটনের যে সামর্থ্য আমি দেখেছি, বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক বড় ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে ওর; যদি না সে নিজেকে নষ্ট করে।
জিম্বাবুয়ে সিরিজে বাংলাদেশের জয় ছাপিয়ে অনেকে আলোচিত ইস্যু বানিয়েছে লিটনের টানা খেলে যাওয়া। সংবাদ সম্মেলনে ব্যখ্যা দিয়েছেন আগে, তবু এখানে আরেকটু বিস্তারিত জানাবেন আপনাদের ভাবনা?
কিন্ত কিছু জায়গায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের ওপর আস্থা রাখা উচিত। দল নির্বাচন, একাদশ নির্বাচন - এসব নির্বাচক ও টিম ম্যানেজমেন্টের ব্যাপার। তারা যখন লিটনকে নিয়েছে বা নিচ্ছে, নিশ্চয়ই লিটনকে নিয়ে সেই বিশ্বাসের জায়গাটা সবার আছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক রান করেছে, সেটা না হয় বাদ দিলাম। টেস্টে দেখুন, ৩টি মাত্র ইনিংস খেলেছে, দুটি ইনিংসই ছিল দারুণ। মানে তার সামর্থ্য আছে। টেস্টে পারলে ওয়ানডেতে আরও বেশি করে পারবে। স্রেফ একটু সময় লাগছে হয়ত। আমি নিশ্চিত করছি, ওর ব্যাটিংয়ের সঙ্গে ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টি খুব ভালো যায়।
আরেকটা ব্যাপার, আগেই বলেছি, বিশ্বকাপ থেকেই আমরা প্রথম নজর দিচ্ছি, কে কত ভালো টিমম্যান। আমরা হারলে বা কোনো সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে পুরো বাংলাদেশ আমাদের বিপক্ষে যেতে পারে। আবার আমরা একসঙ্গে, এক মন হয়ে থাকলে পুরো দেশকে আবার আমাদের পক্ষে আনতে পারি। কিন্তু আমরাই পরস্পরের পাশে না থাকলে কিছুই পারব না, ভেসে যাব। এজন্যই ভালো টিমম্যান দরকার। লিটন খুব ভালো টিমম্যান।
আপনি একটা ‘টিম কালচার’ গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন, লিটনকে দিয়ে একটা বার্তা দেওয়া…
মাশরাফি: সেটাই, শুধু লিটন বলেই নয়। আমরা এই সংস্কৃতিটা গড়ে তুলতে চাই। কাউকে দলে নেওয়া হলে তাকে পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া উচিত। আর আমরা তাকেই বেশি সুযোগ দেব, যে ভালো টিমম্যান। সৌম্য যেভাবে খেলে, প্রতি ম্যাচেই ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু ক্রমাগত ব্যর্থ হলেও আমরা ওকে সমর্থন দেব, কারণ সে দলের জন্য খেলছে!
লিটনও দলের চাওয়া পূরণ করছে। এবার দ্বিতীয় ওয়ানডের কথা মনে করুন। আগের ম্যাচগুলোয় রান পায়নি, কত সমালোচনা, কতটা চাপে ছিল ছেলেটা। চাইলে নিজের জন্য খেলতে পারত। কিন্তু সে উইকেটে গিয়েই স্লগ সুইপে ছক্কা মারল। তাকে দল থেকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সে চেষ্টা করেছে। পরের ম্যাচেও তাই তাকে আমরা সুযোগ দিয়েছি। যে ‘গাটস’ সে দেখিয়েছে, কখনও কখনও পারফরম্যান্সের চেয়ে ওইটা দলের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা এই সংস্কৃতি দাঁড় করাতে না পারলে, এই যে আমাদের ওয়ানডে দলটা দাঁড়িয়ে গেছে, এটাও কিছুদিন পর ভেঙে যাবে। বাইরে সমালোচনা যতোই হোক, দলের ভেতরের পরিবেশ আসল। ড্রেসিং রুমে যদি কোনো নতুন ক্রিকেটার নিরাপদ না ভাবে নিজেকে, তখন তার জন্য পৃথিবীটাই কঠিন হয়ে যাবে। এজন্যই, আমাদের যদি সত্যিই মনে হয় কারও ভালো করার সামর্থ্য আছে, তাকে আমরা পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে চাই।
সৌম্য-লিটনদের মত এতটা নবীন না হলেও আরেকজনের কথা বলা যায়। খুব কঠিন সময় পেছনে ফেলে আল আমিন হোসেন এই সিরিজে খুব ভালো বোলিং করলেন..
ওদের জন্য আমি নিজে নতুন বল হাতে নেই এখন খুব কম। আমার শক্তির জায়গা কিন্তু পুরোনো বল না, নতুন বল। কিন্তু মুস্তাফিজ আসার পর, তাসিকন-রুবেল-আল আমিনরা আছে; আমি নতুন বল খুব কম নিয়েছি। ওদেরকে মেলে ধরার সুযোগটা দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু একজন মাশরাফি তো সব সময় থাকবে না। আমাদের দেশে আমজনতা, সংবাদমাধ্যম, এমনকি বোর্ডেরও অনেকের দিক থেকেই যে চাপ থাকে বা আসবে, ভবিষ্যতে এই তরুণদের সামলাবে কে?
মাশরাফি: আমরা জাতি হিসেবে খুব আবেগী। আবেগটা যেমন বড় শক্তির জায়গা, আবার প্রতিবন্ধকও। আবেগতাড়িত হয়ে আমরা অনেক সময় এমন চাপ দিয়ে ফেলি, ওই ক্রিকেটারের জন্য তখন কাজটা কঠিন হয়ে পড়ে। শচিন-লারা-পন্টিংদের খারাপ সময় এসেছে, সৌম্য-মুস্তাফিজ-লিটনদেরও আসবেই। এটাই স্বাভাবিক। তখন যদি আমরা ছুঁড়ে ফেলতে চাই, তাহলে ক্রিকেট এগোবে না। সোহাগ গাজী দেখেন, আমরা ওর কথা বলিই না এখন। ওটা ওর প্রাপ্য নয়!
আমি কিন্তু আবেগকে অনেক মূল্য দেই। আমার নিজেরও অনেক আবেগ। আবেগকে মূল্য দেই, কারণ আবেগ না থাকলে আমাদের দেশ স্বাধীন হতো না। আবেগ না থাকলে '৭১-এ আমরা যুদ্ধ করতে ঝাঁপিয়ে পড়তাম না। বউ-বাচ্চা-পরিবার সব ফেলে, বাস্তবতার হিসেব ভুলে যুদ্ধ করতে নেমেছি আবেগের কারণেই। আবার আবেগই আমাদের বিভিন্ন সময় পুড়িয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এটার ব্যালান্স করা খুব দরকার।
এই দফায় আপনার নেতৃত্বের এক বছর হতে যাচ্ছে। এত দ্রুত এমন অভাবনীয় সাফল্য ভাবতে পেরেছিলেন?
৫-০ তে জিতলাম জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। এরপর বিশ্বকাপের আগে সব প্র্যাকটিস ম্যাচে আমরা হেরেছি। কিন্তু আমি বিশ্বাস হারাইনি। কোয়ার্টার-ফাইনাল জিতলেই কিন্তু শিরোপার মাত্র ২ ধাপ দূরে থাকতে পারতাম। আমি সব সময়ই বিশ্বাস করি, বড় কিছু অর্জন করতে হলে বড় স্বপ্ন দেখতে হয়।
আপনার মনে আছে হয়ত, বিশ্বকাপে যাওয়ার আগেই সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলাম, ‘এই বছর আমাদের অনেক বড় সিরিজ আছে। বিশ্বকাপে ভালো করলে আমরা পরের সব সিরিজেও ভালো করব।’ সেটাও সত্যি হয়েছে।
বিশ্বকাপের পর পাকিস্তান সিরিজে তামিম অসাধারণ খেলেছে। এরপর ভারত সিরিজে তো মুস্তাফিজ চলে এলো। ওকে দলে নেওয়ার সিদ্ধান্তটি, আমি বলব আমাদের ক্রিকেটের অন্যতম বড় অধ্যায়। মুস্তাফিজ আসায় আমাদের অনেক কিছু অনেক সহজ হয়ে গেছে।
ভারতের অধিনায়ক হওয়ার কদিন পর সৌরভ গাঙ্গুলির চুল পেকে গিয়েছিল। মহেন্দ্র সিং ধোনিরও একই অবস্থা। আগ্রহ, চাপ, বিতর্ক - এসবে আমরাও কম যাই না। আপনার চুল পাকেনি?
মাশরাফি: চুল পাকেনি, তবে চুল পড়ছে! আগেও পড়ত, এখন বেশি পড়ছে! পরিবারকে সময় কম দেওয়া হচ্ছে অনেক। মিটিং করতে হয়, কোচ-সাপোর্ট স্টাফদের সঙ্গে বসে পরিকল্পনা করতে হয়। এতে অনেক অনেক সময় লাগে। তবে আমার স্ত্রী, পরিবার সব সময়ই সমর্থন দিয়ে গেছে। কখনও অভিযোগ করেনি।
চাপ অবশ্যই আছে। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতা জেনেই আমি অধিনায়ক হয়েছি। চাইলে আমি অধিনায়ক না হয়ে বাকি ক্যারিয়ার নিরিবিলি খেলে যেতে পারতাম। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা আমি নিতে চেয়েছি। আমার বাবারও এতে বড় অবদান। জানি না কেন, বাবা সবসময় চেয়েছেন, যেন আমি অধিনায়ক হই। বাসায় অনেক সময়ই আলোচনা হয়েছে, আমি বলেছি নেতৃত্ব নিতে চাই না। কিন্তু বাবা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে।
দল যদি সফল না হতো, এত দিনে আমি হয়ত অধিনায়ক থাকতাম না। এটাও আমি জানি। সব জেনে ও মেনেই অধিনায়ক হয়েছি। সব সময়ই বিশ্বাস করি, ভাগ্য বীরদের পাশে থাকে। আমি যদি নিজের প্রতি সৎ থেকে দেশের জন্য উজার করে দেই, প্রতিদান ভালো পাবই। খারাপ সময় আসবেই, তবে নিজের কাছে যেন প্রশ্ন না থাকে।
ক্যারিয়ারের যে পর্যায়ে এসে নেতৃত্বটা নিয়েছিলেন, ব্যর্থতার ভয় জাগেনি?
২০০৩ সালে যখন লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেল, ডাক্তার পরীক্ষা করে বলল, ‘তোমার তো বাঁ হাঁটুর অবস্থা আরও খারাপ।’ আমি বলে দিলাম, ‘দুই পায়ের অপারেশন করেন’। এক মাস পর বাঁ পায়ে আবার অপারেশন হলো। আমি এসবের ভেতর দিয়ে আজকের জায়গায় এসেছি। কখনই হাল ছাড়িনি। কারণ ক্রিকেটকে যেভাবে ভালোবেসেছি, তাতে আমি বুঝে গিয়েছিলাম, অন্য কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব না। শান্তি পাব না। আমিও অনেক সময় নিজের যত্ন ঠিকমত করতে পারিনি, মানুষ হলে ভুল হতেই পারে। ভুল থেকে শিখেছি।
চাপটা তাই কখনও বড় করে দেখিনি। যখন বেশি চাপ মনে হয়েছে, নিজের জীবনকেই উদাহরণ দাঁড় করিয়েছি। বাংলাদেশে নেতৃত্বের কাজটা কঠিন। মানুষ দ্রুত খুশি হয়। আবার দ্রুত ভুলে যায়, আস্থা হারিয়ে ফেলে। এটা আমাদের দোষ না, ধরনটাই এ রকম। চাপ তাই সবসময়ই থাকে। চ্যালেঞ্জ দেখে কখনো পিছপা হইনি। আমি ভাগ্যবান যে বোর্ডের এবং দলের সবাইকে পাশে পেয়েছি। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ।