‘বাংলাদেশের ক্রিকেটে ডালমিয়ার ছিল অগাধ বিশ্বাস’

সাবেক বিসিবি প্রধান সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, আজকের বাংলাদেশ যে পারফরম্যান্স দেখাচ্ছে, সেটির স্বপ্ন বহু বছর আগেই দেখেছিলেন জগমোহন ডালমিয়া। আর সেই সময়ের বিসিবি সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল হক বলেছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে ডালমিয়ার ছিল অগাধ বিশ্বাস।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Sept 2015, 02:25 PM
Updated : 21 Sept 2015, 02:25 PM

রোববার সন্ধ্যায় কলকাতায় মারা যান বিসিসিআই প্রধান ও সাবেক আইসিসি প্রধান জগমোহন ডালমিয়া। বাংলাদেশ ক্রিকেটের অকৃত্রিম এক বন্ধুকে হারিয়ে শোকে মূহ্যমান বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গন। বিসিবির সাবেক প্রধান সাবের হোসেন চৌধুরী ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল হককে আবেগ একটু বেশিই ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা পাওয়া নিয়ে দুজনই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন ডালমিয়ার সঙ্গে।

শোকাচ্ছন্ন দুজনই ফিরে তাকালেন সেই দিনগুলোতে, সৈয়দ আশরাফুল হক যেসব দিনকে বলছেন, “সোনালি দিন!”

সাবের হোসেন চৌধুরী

বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য দুর্বলতা উনার সবসময়ই ছিল, আমরা সবাই সেটা অনুভব করতে পারতাম। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ছিলেন তো, বাংলাদেশে ক্রিকেটের যে দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি এবং মানুষের যে আবেগ-আগ্রহ এবং স্পন্সরশিপের যে বিপুল সম্ভাবনা; এসব কিন্তু তিনি তখনই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সেটাকে উনি পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন।

উনার যে বিশ্বায়নের স্বপ্ন, সেটার সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্বপ্নকে উনি জুড়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে আমরা আজকে যেটা দেখছি, উনি সেটা বহু বছর আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, বাংলাদেশ বড় একটা ক্রিকেটীয় শক্তি হতে পারে।

আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়াটা ছিল আসলে অনেকগুলো পদক্ষেপের ফল। আমরা সেটা ধাপে ধাপে অর্জন করেছি। প্রেক্ষাপটটা এজন্য বলছি যে প্রতিটি পদক্ষেপে ডালমিয়া সম্পৃক্ত ছিলেন।

প্রথম পদক্ষেপ ছিল এসিসির একটি সনদ পাওয়া। আমরা যেহেতু আইসিসির পূর্ণ সদস্যপদ পাচ্ছি, সেখানে আমরা যে অঞ্চলের সদস্য, তাদের সমর্থন না পেলে তো স্বীকৃতিটা মিলত না। এসিসির সমর্থনটা উনি দারুণ ভাবে ব্যবস্থা করেছিলেন।

দুই নম্বর হচ্ছে, ঢাকাকে কিভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু হসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারি, সেটা ছিল স্ট্র্যাটেজির বড় একটা অংশ। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে মিনি বিশ্বকাপ হয়েছিল, পরে যেটা আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হয়েছে। বাংলাদেশে তখন বন্যা, দেশের অনেক অংশ পানির নিচে। বাংলাদেশে টুর্নামেন্ট হবে কিনা, তা নিয়ে বড় সংশয় দেখা দিয়েছিল। টুর্নামেন্টের আয়োজক হওয়া এবং পরে সেটা ধরে রাখায় ডালমিয়ার যে সমর্থন ছিল, সেটা বলে শেষ হওয়ার নয়।

তিন নম্বর, উনি বিশ্বায়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ক্রিকেটকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমরা কিন্তু সেই প্রেক্ষাপটের সুযোগ নিয়ে টেস্ট স্ট্যাটাসের আবেদন করলাম। উনি যদি বিশ্বায়নকে প্রতিষ্ঠা করতে না পারতেন, তাহলে বাংলাদেশ নিয়েও আমরা এগুতে পারতাম না।

সহযোগী দেশগুলোকে সমন্বিত করতে সহযোগিতা করেছিলেন তিনি। আমি প্রথম যখন আইসিসিতে যাই, তখন তিনজন সদস্য আমরা আইসিসি বোর্ডে পাঠাতে পারতাম। এটা উনার কারণেই সম্ভব হয়েছিল। উনার কথা ছিল, আইসিসি বোর্ডে সহযোগী দেশগুলোরও বক্তব্য থাকা উচিত। রাজস্ব ভাগাভাগিতে সহযোগী দেশগুলোকেও বড় অঙ্কের অর্থ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন ডালমিয়া।

ডালমিয়া শুধু আমাদের টেস্ট মর্যাদা অজনের ক্ষেত্রে নয়, অর্জনের পরে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে ভারতকে আমাদের এখানে পাঠিয়ে আমাদের টেস্ট অভিষেক করিয়েছেন। উনি প্রতিটি জাযগায় সহায়হতা করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ের কথাও যদি বলি, কিছুদিন আগেও আইসিসিতে ভারতের যিনি প্রতিনিধি ছিলেন, তার সঙ্গে একটা ইস্যু হলো। তখন বলাবলি হচ্ছিলো যে, ভারত এখানে আসবে না। তখন কিন্তু ডালমিয়া ব্যবস্থা নিয়েছেন। আমি উনাকে ফোন করেছিলাম। উনি বললেন, “তুমি কোনো চিন্তাই করো না”।

বাংলাদেশের প্রতি উনার সমর্থনটা অসাধারণ। ১৯৯৬ সালে যেমন ছিল, ২০১৫ সালেও তাই। প্রচণ্ডভাবে বিশ্বাসী ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতি। সবসময় বলতেন, ‘একদিন বাংলাদেশ জ্বলে উঠবে। বড় শক্তি হয়ে উঠবে।' সবাই যখন আমাদের সমালোচনা করত, উনি বলতেন, ‘বাংলাদেশ একদিন জেতা শুরু করলে জিততে থাকবে।'

একটা সময়, যখন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর লোক কম ছিল, তখন থেকেই তিনি আমাদের পাশে ছিলেন, একবারও সরে যাননি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভিত্তিটা তৈরি করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন তিনি, পরে ভিত্তিটা জোড়ালোও করেছেন।

উনার যে সবচেয়ে বড় দুটি অর্জন, সেটা আমরা কতটুকু ধরে রাখতে পারলাম? এসিসির ঐক্য উনি দারুণভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৯৮ সালে আমরা বাংলাদেশে ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ করলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে ভারত-পাকিস্তান লড়াই করল পক্ষে-বিপক্ষে, সেই দুই দেশকেই বাংলাদেশের ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপে এনেছিলেন উনি। তার জিনিয়াসের এটা একটা প্রমাণ। তারপর, ২০১১ সালের বিশ্বকাপ অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডে হওয়ার কথা ছিল। ২০০০ সালে দুবাইতে বসে আমরা ঠিক করি যে, বিশ্বকাপটা এশিয়াতে আনব। সেটাই হয়েছে। এশিয়ার সেই ঐক্য কিন্ত পরবর্তীতে নেতত্বে যারা এসেছেন, তারা ধরে রাখতে পারেননি। আর এর ফলে বিশ্ব ক্রিকেটও দুর্বল হয়েছে।

উনার আরেকটা চিন্তা ছিল বিশ্বায়নের। অথচ ক্রিকেট এখন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য সব বিশ্ব খেলায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে দলের সংখ্যা বাড়ছে, আর ক্রিকেটে কমছে। ডালমিয়া, ড. আলি ব্যাখার, জন অ্যান্ডারসন, এহসান মানি, ডেনিস রিচার্ড, তারা ক্রিকেটকে নিয়ে যে চিন্তা করতেন, পরবর্তীতে যারা এসেছেন, তারা ক্রিকেটকে উল্টো পথে টেনেছেন।

সৈয়দ আশরাফুল হক:

১৯৭৯ সালে প্রথম উনার সঙ্গে পরিচয়। ভারতে গিয়েছিলাম। পরিচয় দেওয়ার পর প্রথম যেটা বললেন, ‘ওহ, তুমিই বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ জয়ের নায়ক!’ ওই বছরই আইসিসি ট্রফিতে ফিজিকে হারিয়েছিলাম আমরা, আমি ৭ উইকেট নিয়েছিলাম। তিনি ওসব জানতেন। মানে সেই সময় থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের খোঁজ-খবর রাখতেন।

পরে আস্তে আস্তে আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠি। ১৯৮৩ সালে সিএবি (ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল) দলটাকে আমরা এখানে দাওয়াত দিলাম। উনি দলের সঙ্গে এলেন। সম্পর্ক আরও ভালো হলো। আইসিসি প্রেসিডেন্সি নির্বাচনে উনি আমাকে ক্যাম্পেইন ম্যানেজার বানালেন। উনার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। ১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপের বিডের সময়ও বলেছিলেন, ‘তোমাকে আমাদের প্রয়োজন। সহযোগী দেশগুলোকে পাশে চাই আমি, যেটার ব্যবস্থা তুমি করতে পারবে।’

১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে কলকাতায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সেমি-ফাইনালের অনেক দায়িত্বে ছিলাম। পরে আইসিসি প্রধান হলেন। তখন সহযোগী দেশগুলোর জন্য বরাদ্দ ছিল ৭৫ হাজার ডলার। আমি বললাম ‘জগুদা, এটা ১ লাখ করে দেন।’ উনি বললেন ‘তুমি যখন বললে, করে দিলাম।’

আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ায় উনার অনেক বড় অবদান ছিল। ১৯৯৭ সালে প্রথম আবেদন করি। তখন তো আমাদের দেশের ক্রিকেটে বলতে গেলে তেমন কিছুই ছিল না। টেস্ট খেলা তখনও অনেক দূরের স্বপ্ন। কিন্তু ডালমিয়া বলেছিলেন, ‘আবেদন করে রাখো। বিবেচনা করা হবে।’

১৯৯৮ সালে আমরা এখানে মিনি বিশ্বকাপ করতে পারলাম শুধু তার জন্য। এত বড় একটা ইভেন্ট সহযোগী দেশকে আর কে দিত!

সবসময় পাশে দাঁড়াতেন আমাদের। আইসিসি প্রেসিডেন্টের হওয়ার কথা তো নিরপেক্ষ। কিন্তু উনি সবাইকে আলাদা আলাদা করে ব্যক্তিগতভাবে বলে দিতেন আমাদেরকে সমর্থন করতে। আমাদের ওপর অনেক বিশ্বাস ছিল তার। আমাদের ক্রিকেটের ওপর ছিল অগাধ বিশ্বাস।

উনি স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্রিকেট পুরো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে। ক্রিকেটের বাণিজ্যিক প্রসারটাও উনার হাত ধরেই হয়েছে। ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন তিনিই।