অ্যাকশন বদলে সুযোগের অপেক্ষায় রবিউল

চোট-আঘাত এড়াতে নিজের বোলিং অ্যাকশন একটু বদলেছেন রবিউল ইসলাম। কাজ করছেন ফিটনেস নিয়ে, অপেক্ষা করছেন সুযোগের। গত ৫ বছরে বাংলাদেশের সফলতম পেসার ফিরতে চান টেস্ট দলে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 August 2015, 01:46 PM
Updated : 31 August 2015, 01:46 PM

চোটের ছোবলে অ্যাকশনে বদল

নতুন মৌসুমের প্রস্তুতির জন্য বিসিবির ২৭ সদস্যের এলিট প্লেয়ার্স কন্ডিশনিং ক্যাম্পে আছেন রবিউল। এই কন্ডিশনের মূল উদ্দেশ্যই ফিটনেস ঘষামাজা করা। রবিউলের ক্যারিয়ার সামনে এগোনোর পথে মূল সমস্যাও ওই ফিটনেস।

সোমবার বিপ টেস্ট দিয়েছেন রবিউল, সেখানে ফলাফল গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশ পিছিয়ে। এই ক্যাম্পের আগে ছিলেন তিনি পনিতে (প্লেয়ার্স অব ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট)। সেখানেও চোট পেয়েছিলেন গোড়ালির গাঁটে। তার আগে ছিল কাঁধের চোট। সব মিলিয়ে ফিটনেস সমস্যা নিয়েই তার নিত্য পথচলা।

রোববার অনুশীলন শেষে বিসিবি একাডেমি ভবনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় রবিউল জানান, ফিটনেস নিয়েই এখন তার যত ভাবনা।

“ফিটনেস নিয়ে কাজ করছি। পনিতে অ্যাঙ্কেলে একটু চোট পেয়েছিলাম। ওটা ঠিক হয়ে গেছে। বিপ টেস্টে লেভেল কম আছে। আরও ভালো করতে হবে। রানিং, ট্রেনিং করছি। বোলিংটা হয়ত এই সপ্তাহেই শুরু হবে। ফিটনেস ভালো করাই এখন আমার মূল লক্ষ্য।”

চোট-আঘাত তাকে যথেষ্ট ভুগিয়েছে এর আগেও। বিসিবির কোচ সরওয়ার ইমরানের চোখে রবিউলের অ্যাকশনই তার অন্যতম বড় শত্রু। পনিতে থাকার সময় তাই ইমরানের পরামর্শে রবিউল একটু বদল এনেছেন অ্যাকশনে।

“ডেলিভারির সময় আমার হাত একটু ওপর থেকে আসত, একটু পেছনে যেত। যেটির কারণে আমার ভারসাম্যে সমস্যা হতো। ইনজুরির শঙ্কাও বেশি ছিল। ইমরান স্যারের পরামর্শে এখন হাতটা একটু নিচে নামিয়ে এনেছি। শরীরটা সোজা রেখে একটু সামনে থেকে বল করার চেষ্টা করি।”

রবিউলের বিশ্বাস, অ্যাকশনের এই পরিবর্তনে কমবে তার চোট প্রবণতা, “নতুন অ্যাকশনে কেবল শর্ট রান আপে বোলিং করেছি। ফুল রান আপে, পুরো ছন্দে যখন শতভাগ দিয়ে বোলিং করব, তখন বুঝতে পারব এই অ্যাকশনেই থাকব কিনা। তবে ইমরান স্যার বলেছেন, এটা অনেক ভালো কাজে দেবে। আগের মত ইনজুরি হবে না। আমারও সেটাই ধারণা।”

সেই ‘বোলিং মেশিন’

২০১০ সালে লর্ডসে টেস্ট অভিষেক রবিউলের। ক্রিকেট তীর্থে স্বপ্নের টেস্ট ক্যাপ পাওয়া শেষ পর্যন্ত দুঃস্বপ্ন বানিয়ে ছেড়েছিলেন জোনাথন ট্রট, অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসরা। ওভারপ্রতি প্রায় ৫ রান গুণে উইকেটশূন্য ছিলেন রবিউল। আরেকটি সুযোগের জন্য বছর খানেকের অপেক্ষা!

২০১১ সালে জিম্বাবুয়েতে গিয়ে একমাত্র টেস্টে নেন ৩ উইকেট। পাকিস্তানের বিপক্ষে পরের টেস্টেই আবার একাদশের বাইরে। দ্বিতীয় টেস্টে সুযোগ পেয়ে ১ উইকেট। এবার পরের টেস্ট খেলার জন্য আবার দেড় বছরের অপেক্ষা!

২০১৩ সালের মার্চে শ্রীলঙ্কা সফরে দ্বিতীয় টেস্টে আবার একাদশে ঠাঁই পেলেন। দুই ইনিংসে দুটি করে নিলেন মোট চারটি উইকেট।

অবশেষে এবার টানা দুটি টেস্ট খেলার কপাল হলো। জিম্বাবুয়ে সফরে দুই টেস্টের সিরিজে রবিউল এমন বোলিং করলেন, যেটির তুলনীয় কিছু এখনও করতে পারেননি বাংলাদেশের আর কোনো পেসার।

২ টেস্টে নিয়েছিলেন ১৫ উইকেট, বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে এখনও যেটি কোনো পেসারের এক সিরিজে সর্বোচ্চ উইকেট। হয়েছিলেন ম্যান অব দ্য সিরিজ, এখানেও তিনি প্রথম ও একমাত্র। টেস্টে সিরিজ সেরা হতে পারেননি বাংলাদেশের আর কোনো পেসার।

তবে শুধু উইকেট সংখ্যাই নয়, ওই সিরিজে রবিউল তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন একটানা বোলিং করে। পেস সহায়ক সিমিং কন্ডিশনের উইকেটেও খুব বেশি সুবিধা করতে পারছিলেন না বাংলাদেশের অন্য পেসাররা। রবিউল বলতে গেলে একাই টানেন দলের বোলিং আক্রমণ।

প্রথম টেস্টে করেন ৫৭ ওভার, বাংলাদেশের পেসারদের জন্য যেটি রেকর্ড। ২ টেস্ট মিলিয়ে বোলিং করেন ১১০ ওভার, এখনও সিরিজে ওভারের শতক করতে পারেননি বাংলাদেশের আর কোনো পেসার।

শুধু এটাই নয়, তার একেকটি স্পেল ছিল ম্যারাথনকে হার মানানো। পেসার হয়েও সেই সিরিজে করেছেন ১৩ ওভার, ১২ ওভার, ১১ ওভার, ১০ ও ৯ ওভারের স্পেল! টানা বোলিংয়ের জন্য সে সময় পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিলেন ‘বোলিং মেশিন’ হিসেবে।

সিরিজ সেরার পুরস্কার নিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দলের প্রয়োজন হলে আরও ১০০ ওভার বোলিং করতে পারব!” ধারাভাষ্যকাররা বলছিলেন, 'লায়ন হার্টেড' ফাস্ট বোলার!

অথচ অমন পারফরম্যান্সের পরও পরের আড়াই বছরে খেলতে পেরেছেন আর মাত্র ৩টি টেস্ট! সেটিও ৩ দফায় ৩ সিরিজে।

২০১৩ সালে ওই জিম্বাবুয়ে সফরের পর দেশের মাটিতে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে উইকেট পেলেন না, মিরপুর টেস্টেই বাদ। পরের বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে খেলে উইকেট পেলেন না, চট্টগ্রাম টেস্টেই বাদ! কখনো চোট, কখনো উপেক্ষা; টানা দুটি টেস্ট খেলার সুযোগ রবিউলের আর হয়ই না!

সবশেষ গত সেপ্টেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে প্রথম টেস্টে বসে থাকার পর সুযোগ মিলেছিল দ্বিতীয় টেস্টে। উইকেট পেয়েছিলেন দুটি। এরপর আরেকটি সুযোগের অপেক্ষায় আবার প্রহর গোণা শুরু তার!

তবুও সফলতম

নিত্য সঙ্গী চোট। বারবার সইতে হয়েছে উপেক্ষার যন্ত্রণা। ৫ বছরের ক্যারিয়ারে খেলতে পেরেছেন মাত্র ৯টি টেস্ট। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, তারপরও রবিউলের অভিষেকের (২০১০ সালে ২৭ মে) সময় থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সফলতম টেস্ট পেসার তিনিই!

৯ টেস্টে ২৫ উইকেট রবিউলের। এই সময়ে ২১টি উইকেট রুবেল হোসেনের, ১৬ টেস্ট খেলে! ১১ টেস্ট খেলে শাহাদাত হোসেনের উইকেট মোটে ১২টি। ৪ টেস্টে ১০ উইকেট শফিউলের।

২০১৩ সালের ওই স্বপ্নের জিম্বাবুয়ের সফরের পর থেকে সুযোগ পাওয়া তিন টেস্টের দুটিতেই উইকেটশূন্য ছিলেন রবিউল। একটিতে নেন ২ উইকেট। পারফরম্যান্স অবশ্যই দারুণ কিছু নয়। কিন্তু পারফরম্যান্স ভালো ছিল না তো বাংলাদেশের কোনো পেসারেরই। এই সময়ে ৭ টেস্টে সুযোগ পেয়ে মাত্র ৭ উইকেট রুবেলের, ৬ টেস্টে ৬ উইকেট আল আমিন হোসেনের। ৫ টেস্টে ৫ উইকেট মোহাম্মদ শহীদের, ৩ টেস্টে ২ উইকেট শাহাদাতের। অথচ দেশের মাটিতে মরা উইকেটে একটি-দুটি টেস্টের ব্যর্থতায় বারবার বাদ পড়েছেন রবিউল।

সদাহাস্য রবিউলকেও প্রায়ই ছুঁয়ে যায় সেই হতাশা, “বাইরে থাকলে তো কারও ভালো লাগে না। খেলতে না পারার খারাপ লাগা ছিলই। আমারও ইনজুরি ছিল, আবার এমনিতেও বাদ পড়েছি। সব মিলিয়ে খারাপ তো লেগেছে।”

স্বপ্ন দেখে মন

নতুন মৌসুম মানে নতুন শুরু। হতাশা ভুলে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ। রবিউলও বুক বাঁধছেন নতুন আশায়। আপাতত চ্যালেঞ্জ, ফিটনেস পুরো ফিরে পাওয়া।

“ফিটনেস নিয়ে যেহেতু প্রশ্ন উঠেছে বারবার, এটা নিয়েই তাই বেশি কাজ করছি। যেন এটা নিয়ে কেউ কথা বলতে আর না পারে। মাঠেও যেন শতভাগ দিতে পারি।”

অস্ট্রেলিয়া সিরিজের আগেই ফিটনেস ফিরে পাওয়ার লক্ষ্য। তবে ওই সিরিজে খেলতেই হবে, এমন কোনো লক্ষ্যও বেধে দিচ্ছেন না নিজেকে।

“অস্ট্রেলিয়া সিরিজ মাথায় আছে। তবে খেলতেই হবে, এমন কোনো চাপ নিচ্ছি না। জাতীয় লিগ আছে, সেখানে পারফর্ম করতে চাই। ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করলে ডাক পাবই।”

আর টেস্ট দলে ফিরলে সেই আগের মতো “বোলিং মেশিন” হয়েই ফিরতে চান রবিউল।

“লম্বা স্পেলে বোলিং করা আর আউট সুইঙ্গারটাই আমার শক্তির জায়গা। সেসব নিয়েই দলে ফিরতে চাই। সেভাবেই নিজেকে তৈরি করছি। লম্বা স্পেল। জানি কাজটা কঠিন। পেস বোলাররা সবাই খুব ভালো করছে। তাদের জায়গা নিতে হলে ভালো কিছু করতে হবে। এজন্যই ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করতে চাই।”

একটি জায়গায় তার সময়ের আর সব ক্রিকেটারের সঙ্গে তুলনায় উজ্জ্বল ব্যতিক্রম রবিউল। রঙিন পোশাক আর সংক্ষিপ্ত ক্রিকেটের ঝলমলে জগতের চেয়ে তাকে বেশি টানে সাদা পোশাকের ঐতিহ্য আর চ্যালেঞ্জ। ক্যারিয়ার নিয়ে তার স্বপ্নও টেস্টকে ঘিরে।

“সবসময়ই আমি টেস্ট খেলতে চাই। ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টিও খেলতে চাই। তবে টেস্ট খেলতেই বেশি ভালো লাগে। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে আমার লক্ষ্য বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল টেস্ট পেসার হওয়া। এখনও সেই লক্ষ্য আছে। মাশরাফি ভাইকে (৭৮ উইকেট) টপকাতে চাই। এখন সুযোগটা পেলে হয়!”

রবিউলের শেষ কথাটি কি নির্বাচকদের জন্য একটি বার্তা? প্রশ্ন শুনে হাসলেন রবিউল। কণ্ঠে প্রত্যয়, “নির্বাচক কমিটি যদি মনে করে শিবলুকে (রবিউলের ডাক নাম) আবার দরকার দলে, তাহলে তারা ডাকবেন। আমি প্রস্তুত থাকব।”