প্রতিবন্ধী ক্রিকেটাররাই আসল বীর: মাশরাফি

শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আগামী মাসে বাংলাদেশে হতে যাওয়া আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের শুভেচ্ছাদূত হওয়াটাকে জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের অধিনায়ক দর্শকদের খেলা দেখতে মাঠে আসার অনুরোধও জানিয়েছেন।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 August 2015, 02:26 PM
Updated : 26 August 2015, 02:26 PM

২ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়াম ও বিকেএসপিতে এই আইসিআরসি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্টটি অনুষ্ঠিত হবে। ৫ জাতির টুর্নামেন্টে স্বাগতিক বাংলাদেশসহ অংশ নেবে ইংল্যান্ড, আফগানিস্তান, ভারত ও পাকিস্তান।

টুর্নামেন্টের মিডিয়া পার্টনার দেশের প্রথম অনলাইন সংবাদপত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

বিসিবি টুর্নামেন্টের শুভেচ্ছাদূত মনোনীত করেছে এমন এক জনকে, দেশের সব শ্রেণির মানুষের কাছে যিনি একরকম আদর্শ। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কদিন আগে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক, ফিরেছেন মঙ্গলবার রাতে।

বুধবার মিরপুর শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের টুর্নামেন্ট নিয়ে আলাপচারিতায় মাশরাফি খুলে দিলেন মনের দুয়ার। জানালেন উচ্ছ্বাস আর ভালো লাগার কথা।

টুর্নামেন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া

বিসিবি আমাকে শুভেচ্ছাদূত মনোনীত করায় দারুণ খুশি হয়েছি এবং সম্মানিত বোধ করেছি। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহানুভূতি, সুদৃষ্টি হয়ত অনেকেরই থাকে। কিন্তু ওরা আসলে সহানুভূতি চায় না, চায় অনুভূতি। চায় আমরা ওদেরকে অনুভব করি, বুঝতে পারি।

এই টুর্নামেন্ট বাংলাদেশে হচ্ছে বলে আমি আরও খুশি। আমাদের বাংলাদেশে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের যথার্থ সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয় না। নিজের এলাকার একটি ঘটনা বলি। আমার খুব কাছের বন্ধুর বড় ভাই, নাম অপূর্ব। সেও আমার বন্ধুর মতো। জন্ম থেকেই সে একটু কুঁজো। সবাই ওর সাথে এটা নিয়ে মজা করত, নাম বিকৃত করে ডাকত। আমি মজা করেও কখনও তা করিনি। সবসময়ই অপূর্বই ডেকেছি, নাম বিকৃত করলে আমি সবাইকে অনেক কথাও শুনিয়েছি সব সময়। ওকে আমি সব সময় আগলে রাখার চেষ্টা করতাম। শুধু তাই নয়, ফুটবল-ক্রিকেট খেলায় কেউ ওকে নিতে চাইত না। আমি সবসময় ওকে আমার দলে নিয়েছি। ওরও মন চায় খেলতে, ওরও অধিকার আছে খেলার।

আমাদের দেশের মতো প্রতিবন্ধীদের এতটা অবহেলা বা এতটা তাচ্ছিল্য সম্ভবত আর কোথাও হয় না। আমরা ফাজলামো করেও কত অনায়াসেই বলে দেই, “এই ল্যাংড়া, এই খোড়া বা ট্যারা, পঙ্গু।” এই শব্দগুলি দেখেছি আমাদের দেশে বা আমাদের সমাজে অহরহ বলা হয়। যতই ওদের কাছে বা পাশে থাকি না কেন, ডাকার সময় দেখা যায় এভাবেই ডাকি। একবারও ভাবি না, মজা করে বললেও ওদের কষ্ট লাগতে পারে।

ওদের নিয়ে ভাবনা আমার সব সময়্ই ছিল। এবার এই টুর্নামেন্টে সম্পৃক্ত হতে পেরে আরও ভালো লাগছে।

সামাজিক অধিকার ও বার্তা

আমার সবচেয়ে ভালো লাগছে আমাদের দলের ছেলেগুলোর জন্যই। কত কষ্টের ভেতর থাকতে হয় ওদের, কত সীমাবদ্ধতা। পরিবার, সমাজ, চারপাশের লোকজন, কারও কাছ থেকে প্রাপ্যটা পায় না ওরা। এত কিছুর মধ্যেও যে এরা খেলছে, খেলার আনন্দটা পাচ্ছে, এটাই অনেক বড় ব্যাপার। খেলার এই আনন্দটা ওদেরও প্রাপ্য। ওদেরও অধিকার আছে জীবনটা উপভোগের।

সবচেয়ে বড় কথা অন্যদের জন্য এটা একটা বার্তাও। ওদের মতোই আরও অনেকে যারা ঘরে বসে থাকে, তারা অনুপ্রেরণা পেতে পারে। উদ্দীপ্ত হতে পারে। শারীরিক প্রতিবন্ধী যাদের নিয়ে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন হতাশ, সেই বাবা-মারা এই ক্রিকেটারদের দেখে অন্তত অনুভব করতে পারে যে আমাদের সন্তানকেও আমরা স্বাভাবিক একটা জীবন দেওয়ার চেষ্টা করি।

আমাদের দেশে শারীরিক প্রতিবন্ধীরা নিজের পরিবারেই অনেক অবহেলিত থাকে। সবাই ভাবে, ‘ওরা আর এমন কী…এই তো খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, টিভি দেখছে, এই যথেষ্ট।‘ কিন্তু পরিবারের মানুষও বোঝে না, আর দশটা মানুষের মানসিকতা যেমন, ইচ্ছে হলো সাইকেল-রিক্সা বা গাড়িতে ঘুরতে চলে গেলাম, ওরও তো ওই একই ইচ্ছা করে! আল্লাহ ওর মনটাকে তো প্রতিবন্ধী করে দেন নাই। কিন্তু ওরা যা ইচ্ছা-খুশি করতে পারে না, অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই টুর্নামেন্ট দিয়ে অনেক পরিবার হয়ত আরও সচেতন হবে, ‘আমরা এটা করছি, ওকেও সঙ্গে নেই।’ কিংবা বুঝতে পারবে ওর জীবনটা আরেকটু আনন্দময় করে তুলি। বুঝতে পারবে যে, আমার ছেলেটাও কিছু করতে পারে। এমন নয় যে, এই করে সংসার চালাবে বা পরিবার টানবে, কিন্তু নিজের জীবনটা নিজের মতো করে উপভোগ করার অধিকার তার আছে।

জীবন থেকে নেওয়া

আমি হয়ত শারীরিক প্রতিবন্ধী নই। কিন্তু আমারও অনেক শারীরিক সমস্যা আছে। কতবার লিগামেন্ট ছিড়ল, কত কত অস্ত্রোপচার পায়ে, আমি এজন্য আরও ভালো করে অনুভব করতে পারি ওদের ভেতরটা। আমি একজন সুস্থ মানুষ, স্রেফ কিছু চোট-সমস্যা জয় করে ফেলেছি বলে লোকে আমাকে বীরের সম্মান দেয়। ওদের তো কারও হাত নেই, পা নেই, আরও কত সমস্যা। কিন্তু সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে ওরা সামনে এগোচ্ছে, এরকম একটা ক্রিকেট টুর্নমেন্টে খেলছে, ওরাই সত্যিকারের বীর। আরও বেশি সম্মান ও কৃতিত্ব প্রাপ্য ওদের।

ওদের খেলা আমি দেখেছি। তবে কেমন খেলে বা কিভাবে খেলে, এটা অন্য ব্যাপার। ওরা ওদের মতো করেই খেলবে। ওরা যে খেলছে, এতেই আমি মুগ্ধ। ওদের এই মানসিক শক্তি দেখেই ভালো লাগে। ওরা খেলছে, ব্যাটিং-বোলিং করছে, লোকে ওদের খেলা দেখতে মাঠে আসবে, ওদের জন্য এটা হবে বড় অনুপ্রেরণা। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ওরা জীবনকে আরও বেশি ভালবাসতে পারবে।

মানসিক তৃপ্তি

সব দিক মিলিয়েই যত পণ্যেরই ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হই না কেন, যত বিজ্ঞাপনই করি, গত কয়েক মাসে যেটা বেশ অনেকটাই অভিজ্ঞতা হয়েছে, কিন্তু এত আনন্দ আর ভালো লাগা জীবনে আর কিছুতে পাইনি। বিসিবি আমাকে মনোনীত করেছে বলেও আমি দারুণ কৃতজ্ঞ। ওদের জন্য কিছু একটা করার সুযোগ অন্তত পেয়েছি। হয়ত এটা এমন কিছুই না, খুব বড় কিছু নয়, তারপরও অন্তত কিছু মানুষের অনুপ্রেরণা হতে পারলেও বড় পাওয়া।

দর্শকের কাছে চাওয়া

আমি অবশ্যই খেলা দেখব যতটা পারি। দর্শকদেরও অনুরোধ করব মাঠে গিয়ে ওদের খেলা দেখতে। ওরাও কিন্তু আমাদের দেশকেই প্রতিনিধিত্ব করছে। বাংলাদেশের ম্যাচ যত মানুষ দেখে, ওর ৫ ভাগ লোকও ওদের খেলা দেখলে ওরা অনেক অনুপ্রাণিত হবে। সব পরিবার, সমাজও অনেক সচেতন হবে।

আইসিআরসি, বিসিবিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এমন উদ্যোগের জন্য। আর বাংলাদেশ দলের জন্য থাকল শুভকামনা।

</div>  </p>