মাশরাফির আয়নায় সাঙ্গাকারা-ক্লার্ক

ক্রিকেট বিশ্বের দুই প্রান্তে দুই গ্রেটের শেষের শুরু হচ্ছে বৃহস্পতিবার। কলম্বো টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন কুমার সাঙ্গাকারা; ওভাল টেস্ট দিয়ে মাইকেল ক্লার্ক। দুজনের সঙ্গেই মাঠের ভেতরে-বাইরে অনেকটা সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা আছে মাশরাফি বিন মুর্তজার। দুই গ্রেটের বিদায় লগ্নে তাদেরকে নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা আর ভাবনার কথা জানালেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক ও এখনকার দলের সবচেয়ে পুরোনো এই ক্রিকেটার।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 August 2015, 11:37 AM
Updated : 19 August 2015, 11:56 AM

পারিবারিক প্রয়োজনে বুধবার রাতে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা মাশরাফির। ব্যস্ত ছিলেন সেটির শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে। তবে ক্লার্ক-সাঙ্গাকারার অবসরের প্রসঙ্গ তুলতেই অনেকটা সময় দিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে। অতীতের আয়নায় তাকিয়ে খুলে দিলেন ক্লার্ক-সাঙ্গাকারার সঙ্গে স্মৃতির ঝাঁপি।

“দুজনের সঙ্গেই আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। অনেকে মনে করতে পারে, দুজন একসঙ্গে অবসরে যাচ্ছে বলেই এমনটা বলছি, কিন্ত আসলেই ভালো সম্পর্ক ছিল। কত বড় বড় ক্রিকেটারের সঙ্গেই তো খেলেছি, চেনা-পরিচয় আছে। বেশিরভাগের সঙ্গেই সম্পর্কটা ‘হাই-হ্যালো’ বা আরেকটু আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু ওই দুজনের সঙ্গে আন্তরিকতা অন্যরকম। অনেক কথা হয়েছে আমাদের।”

কুমার সাঙ্গাকারা

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাশরাফি ও সাঙ্গাকারার আগমন কাছাকাছি সময়েই। ২০০০ সালের জুলাইয়ে অভিষেক সাঙ্গাকারার, পরের বছর নভেম্বরে মাশরাফির। আন্তর্জাতিক আঙিনায় দুজনের প্রথম দেখা ২০০৩ বিশ্বকাপে, পিটারমারিজবার্গে। সেই থেকে টেস্ট-ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে সাঙ্গাকারার বিপক্ষে ২৩টি ম্যাচ খেলেছেন মাশরাফি। তাকে আউট করতে পেরেছেন ৩ বার। দেখেছেন বাংলাদেশের বিপক্ষে রানের স্রোত বইয়ে দিতে। নিজের দেখা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সাঙ্গাকারাকেই সবার ওপরে রাখছেন মাশরাফি।

“ভিভ রিচার্ডসের খেলা তো দেখিনি, এখন ভিডিওতে দেখি। স্টিভ-মার্ক ওয়াহদের খেলাও টিভিতে দেখেছি। শচিন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা, রিকি পন্টিং, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ, জ্যাক ক্যালিসদের বিপক্ষে খেলেছি, ব্যাটিং কাছ থেকে দেখেছি। টেন্ডুলকারের প্রতি অন্যরকম ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকবেই, কিন্তু আমার দেখাদের মধ্যে সেরা সাঙ্গাকারাই।”

সাঙ্গা কেন সেরা, সেই ব্যখ্যাও দিলেন মাশরাফি।

“মূলত টেস্টে সাঙ্গাকারার ব্যাটিংয়ের কারণে। লারা-টেন্ডুলকারের অনেক গ্রেট ইনিংস অবশ্যই আছে। কিন্তু আমি যতটা দেখেছি, আমার কাছে টেস্ট ব্যাটিংয়ের আদর্শ মনে হয়েছে সাঙ্গাকারাকে। প্রায় নিখুঁত টেকনিক, অসাধারণ ড্রাইভ খেলে, স্পিন-পেস দুটিতেই সমান স্বচ্ছন্দ। এতগুলো ডাবল সেঞ্চুরি করেছে, সেটাও ওকে আলাদা করে তুলেছে (১১টি দ্বিশতক সাঙ্গাকারার, রেকর্ড ১২টি ডন ব্র্যাডম্যানের)। আর টেস্টে যে এতটা ভালো খেলে, ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টি তার জন্য কিছুই না। সেটা সাঙ্গাকারা দেখিয়েছেও।”

সাঙ্গাকারা ক্রিকেট বিশ্বে আলাদা হয়ে আছেন ব্যাটিংয়ের প্রতি তার নিবেদনের কারণেও। শ্রীলঙ্কার সাবেক কোচ ও এখন ইংল্যান্ডের সহকারী কোচ পল ফারব্রেস যেমন বলেছেন, “আমার দেখা সেরা প্রফেশনাল ক্রিকেটার সাঙ্গা।” দীর্ঘদিনের সতীর্থ ও কাছের বন্ধু মাহেলা জয়াবর্ধনে বলেছেন, ম্যাচের আগে সাঙ্গাকারার প্রস্তুতি সবসময়ই থাকত নিখুঁত। সাঙ্গাকারার নিবেদনের একটা উদাহরণ দিলেন মাশরাফিও।

“প্রতিপক্ষ দলের সবকিছু তো আর দেখতে পাই না আমরা। তার পরও যতদূর দেখেছি, সাঙ্গা অনেক পরিশ্রমী আর ব্যাটিংয়ের প্রতি নিবেদিত। একটা ঘটনা বলতে পারি। ২০০৭ সালে আমাদের শ্রীলঙ্কা সফরে সাঙ্গা প্রথম টেস্টে শাহাদাতকে পুল করতে গিয়ে আউট হলো (৬ রানে)। পরের দুই টেস্টেই সে অপরাজিত ডাবল সেঞ্চুরি করেছিল। সেঞ্চুরির আগে একটা পুল শটও সম্ভবত খেলেনি। একের পর এক শর্ট বল ছেড়ে দিয়েছে। সেঞ্চুরির পরও পুল খেলেছে একদম শিওর হলে। এটাই প্রমাণ করে ওর মনোযোগ ও নিবেদন কতটা।”

ব্যাটসম্যান সাঙ্গাকারাকে সেরা বলতে একটু ভাবতে হয়েছে মাশরাফিকে, কিন্তু মানুষ সাঙ্গাকারা যে সেরা, এটা বলতে ভাবতে হয়নি একটুও।

“দেখুন ক্রিকেট বিশ্বজুড়ে সবাই যখন বলছে সাঙ্গা ব্যক্তি হিসেবে কত বড়, সেটার নিশ্চয়ই কারণ আছে! আমিও প্রমাণ পেয়েছি অনেকবার। ২০০৭ সালে ডাবল সেঞ্চুরি দুটি করল, পরে আমার কাছে এসে বললো, ‘তোমরা মনে হয় আমাকে বড় ব্যাটসম্যান ভাবো না।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন বলছো এই কথা?’ সে বলে, ‘তোমাদের ব্যাটসম্যানরা তো আমার কাছে কিছু শুনতে বা কথা বলতে এলো না!’ আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, ‘আসলে তুমি এত বড় ক্রিকেটার, এজন্য সবাই সমীহ করেই দূরে থাকে।’ পরে সে নিজে থেকেই সবার সঙ্গে কথা বলেছে।”

সাঙ্গাকারার সান্নিধ্য অনেক পেয়েছেন বলেও দারুণ ভালো লাগা আছে মাশরাফির।

“২০০৯ সালে ঢাকায় ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে ৬ রানে শ্রীলঙ্কার ৫ উইকেট ফেলেও আমরা জিততে পারলাম না। ওই সময়টায় আর আগের এক-দেড় বছর আমি ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং করছিলাম। ফাইনাল শেষে সাঙ্গা বললো, ‘সি ইউ ইন সাউথ আফ্রিকা।’ ওই বছর আইপিএল ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়, সেদিকেই ইঙ্গিত। সে তখন কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবে খেলে। সাঙ্গাকারার অনুরোধে নিলামে প্রীতি জিনতা অনেক চেষ্টাও করেছিল আমাকে দলে নিতে, শেষ পর্যন্ত জুহি চাওলারা জিতে গেল। তবে সাঙ্গার সঙ্গে সময় কাটিয়েছি বেশ। পরেও সবসময়ই দেখা হলেই সাঙ্গা নিজে থেকে এসে অনেক অনেক কথা বলত। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে সে সুযোগ করে দিয়েছে বলেই। এতটুকু অহমিকা দেখিনি কখনো।”

মাশরাফির চাওয়া, ক্রিকেট ছাড়লেও ক্রিকেটের সঙ্গেই থাকবেন সাঙ্গাকারা।

“সাঙ্গার বিদায়ে ক্রিকেটের শেষ ক্লাস ব্যাটসম্যানও চলে যাচ্ছে। বিরাট কোহলি এভাবে খেলতে থাকলে হয়ত ওই পর্যায়ে যেতে পারে একদিন। আর তো নেই। আর শুধু ব্যাটিংই নয়, ক্রিকেট নিয়ে সাঙ্গাকারার ভাবনাই অন্যরকম। যখনই কথা হয়েছে, দেখেছি ক্রিকেট নিয়ে ওর চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণাই অন্যরকম। শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, বিশ্ব ক্রিকেট নিয়েই। আমার আশা, সাঙ্গা ক্রিকেটের সঙ্গেই থাকুক কোনো না কোনোভাবে। বিশ্ব ক্রিকেটেরই তাতে ভালো হবে।”

মাইকেল ক্লার্ক

অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ খেলার সুযোগই পায় কালেভদ্রে। মাশরাফি তো আরও চোটের কারণে মাঠের বাইরে কাটিয়েছেন অনেক অনেক সময়। আন্তর্জাতিক আঙিনায় তিন সংস্করণ মিলিয়ে ক্লার্কের বিপক্ষে মাশরাফি খেলেছেন ১৫টি ম্যাচ। তাকে আউট করেছেন দুইবার।

সাঙ্গাকারার মতো ক্লার্কের সান্নিধ্য অতটা পাওয়ার সুযোগ হয়নি, তার পরও সুযোগ হয়েছে মেশার। ক্লার্ককে নিয়ে অজানা এক চমকপ্রদ অধ্যায়ের কথাও জানালেন মাশরাফি।

“আমার ক্যারিয়ারের ভীষণ দু:সময়ে অনেক বড় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল ক্লার্কের একটি কথা। ২০১১ বিশ্বকাপের পর ক্লার্ক অধিনায়ক হয়ে এলো বাংলাদেশে। একটা ম্যাচের সময় ওর কাছে গিয়ে বললাম, ‘টাফ লাক, অস্ট্রেলিয়া কোয়ার্টার-ফাইনালে হেরে গেল..।’ সে উল্টো বললো, ‘তোমার হাঁটুর কি অবস্থা?’ আমি তো অবাক, ক্লার্ক আমার চোটের খবর জানে!’

মাশরাফির বিস্ময় আকাশ ছুঁলো, যখন জানলেন ক্লার্ক তার চোটের ইতিহাস প্রায় সবই জানেন।

“ক্লার্ক বললো সে সবকিছুই জানে আমার। আমি বললাম, ‘এখনও ফিট নই, অনেকটা চাপে পড়েই খেলতে বাধ্য হচ্ছি। তখন সে বললো, ‘হাল ছেড়ো না, লড়াই চালিয়ে যাও। দ্রুত ফিট হয়ে ওঠো। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তোমাকে অনেক অনেক বেশি দরকার।’ অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক ও এত বড় তারকা যখন এমন কথা বলে, এর চেয়ে বড় প্রেরণা আর কি হতে পারে! চোটের সঙ্গে লড়াইয়ে কখনো ক্লান্তি এলেই ক্লার্কের কথাটি আমার কানে বাজত।”

সাঙ্গাকারার মতোই ব্যাটসম্যান ক্লার্ক মাশরাফির কাছে আলাদা হয়ে আছেন টেস্টের পারফরম্যান্সের কারণে।

“ক্লার্ক হয়ত টেন্ডুলকার-লারাদের কাতারে নয়, কিন্তু মনে রাখার মত অসাধারণ সব ইনিংস সেও খেলেছে। দারুণ স্টাইলিশ ব্যাটসমান, ব্যাটিং দেখতে মজা লাগত। বিশেষ করে স্পিনে ফুটওয়ার্ক দারুণ। অধিনায়ক হওয়ার পরে সে যত সেঞ্চুরি-ডাবল সেঞ্চুরি করেছে, সেটাও প্রমাণ করছে কত বড় ব্যাটসম্যান।”

গত বিশ্বকাপ খেলতে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে ক্লার্কের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন মাশরাফি।

“বিশ্বকাপের আগে আমাদের ব্রিসবেন ক্যাম্পের সময় একটা প্র্যাকটিস ম্যাচে ক্লার্ক খেলেছিল। সেদিন ওর সঙ্গে ৪৫ মিনিটের মত কথা হয়েছিল। পরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আমাদের ম্যাচের আগেও কথা হয়েছে। অধিনায়কত্ব নিয়ে কথা হয়েছিল অনেক। এত চাপ-সমালোচনা, বাইরের কথা, এসব কিভাবে সামলায় জিজ্ঞেস করলে বলেছিল, ‘ধুর, ওসব আমি পাত্তাই দেই না। দলটা আমার, দলের ভালোর জন্য নিজে যা মনে করি, সেটাই করি।’ ওই কথাটি আমার জন্য ছিল একটা শিক্ষা।”

নেতৃত্বের ধরন-দর্শনে দুজন একই ঘরানার। আগ্রাসী ক্রিকেট পছন্দ দুজনেরই। মাশরাফি অবশ্য তুলনাতে যেতেই রাজি নন।

“ওদের সঙ্গে আমার তুলনা হয় না। আমি সত্যি বলতে সেভাবে কাউকে অনুসরণও করি না। তবে আমার সবসময়ের প্রিয় অধিনায়ক রিকি পন্টিং। সবাই যে কারণে ওকে কৃতিত্ব কম দিতে চায়, যে পন্টিং দলটা ভালো পেয়েছিল, আমি সেই কারণেই কৃতিত্ব বেশি দেই। কারণ দলের সবাই তারকা হলে দলটাকে ম্যানেজ করা, এক সুতোয় গাঁথা, নেতৃত্ব দেওয়া আরও কঠিন।”

তবে একটা জায়গায় নিজের প্রিয় অধিনায়কের চেয়েও মাশরাফি এগিয়ে রাখছেন ক্লার্ককে।

“যে দলটাকে নিয়ে ক্লার্ক বিশ্বকাপ জিতেছে, সেটা বলতে গেলে তারই দল। নিজেই দলটাকে গড়ে তুলে বিশ্বকাপ জিতিয়েছে। সেদিক থেকে পন্টিংকেও ছাপিয়ে গেছে ক্লার্ক। ওর অভাব পূরণ করা কঠিন। তবে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ধরণটাই এমন যে কেউ না কেউ জায়গা নিয়ে নেবেই।”