বছরখানেক আগে টেস্টের নেতৃত্ব পেয়েছেন। এখনও টেস্ট হারেননি একটিও, সিরিজ হারেননি। নেতত্বের পথে কিভাবে এগিয়ে যেতে চান? নিশ্চয়ই একদিন গ্রেট হয়ে উঠতে চান?
হাশিম আমলা: ১১-১২ বছর হয়ে গেল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছি। বছর দশেক গ্রায়েম স্মিথের নেতৃত্বে খেলেছি। যাদের নেতৃত্বে খেলেছি, সম্ভবত গ্রায়েমই সেরা। ঘরোয়া ক্রিকেটে ডেল বেনকেনস্টেইনের নেতৃত্বে খেলেছি, আরও বেশ ক’জন ছিল। স্বাভাবিকভাবেই সবার কাছ থেকেই কিছু না কিছু শিখেছি।
গত বছর যখন নেতৃত্বটা এল, এই দলের অধিনায়ক হওয়ার যখন সৌভাগ্য আমার হলো, কোনো সংশয় নেই যে অতীতের সব অভিজ্ঞতাই কাজে লাগবে। যাদের সংস্পর্শে এসেছি এবং নিজে যতটা দেখেছি - সব অভিজ্ঞতাই। নেতৃত্ব ব্যাপারটা এমন নয় যে একটা জায়গায় শেষ করা যায়। যেমন, একটা বই পড়ে শেষ করলাম আর সব জানা হয়ে গেল! নেতৃত্ব তেমন নয়। আমি নিশ্চিত, গ্রেট অধিনায়কদেরও জিজ্ঞেস করলে তারা এটাই বলবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক শিক্ষা হয়।
আমার মাত্রই বছরখানেক হলো, সাতটি টেস্ট ম্যাচ। আমার জন্যও এটি ছিল শেখার সময়। খুব গোছানো একটি টেস্ট দল পেয়েছিলাম আমি, যারা খুব ভালো করছিল। আমি নেতৃত্ব পাওয়ার পরও গত বছর বেশ কিছু উল্লেখ করার মতো পারফরম্যান্স ছিল আমাদের। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কায় সিরিজ জয়, যেখানে ভালো করা সবসময়ই কঠিন। কিন্তু আমরা দারুণ করেছি। আমার তো মনে হয়, প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলাম, বিশেষ করে স্মিথ ও ক্যালিসের অবসর নেওয়ার কথা মাথায় রাখলে।
এই সফরেই হয়তো আমরা ওই তিনজনকে হারানোর প্রথম প্রভাবটা বুঝতে পারছি, গ্রায়েম স্মিথ, জ্যাক ক্যালিস ও আলভিরো পিটারসেন। এখন আমাদের টেস্ট দলের দিকে তাকালে দেখবেন অনেক নতুন মুখ। বিশ্বজুড়ে অনেকেই টিভি খুলে দেখে বলবে সাইমন হার্মার আবার কে? ডিন এলগার কিছু ম্যাচ খেলেছে; স্টিয়ান ফন জিল, টেম্বা বাভুমা, এরা কে? সব মিলিয়ে নতুন একটা টেস্ট দল। ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টিতে চ্যালেঞ্জটা অতটা বড় নয়; তবে যেহেতু ৭-৮ বছর ধরে মোটামুটি থিতু একটা দল ছিল আমাদের, এখন তাই পালাবদলের সময়। আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো, জয়ের ধারা ধরে রাখা এবং একই সঙ্গে এই ছেলেদের গড়ে তোলা। যাতে আমরা যখন বিদায় নেব, দল যেন থমকে না দাঁড়ায়।
নেতৃত্ব শেখার কথা বললেন। কিন্তু আপনি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে নাটালের অধিনায়ক হয়েছেন ২১ বছর বয়সে। সবাই জানত, আপনি দক্ষিণ আফ্রিকার ভবিষ্যত অধিনায়ক। নেতৃত্বের গুণাবলী কি আপনার সহজাত?
গত বছরের আগে আমি নেতৃত্ব নিতে চাইনি। গ্রায়েম অবসর নিলে আমরা অনেকেই চমকে গিয়েছিলাম। বেশিরভাগই এটা আশা করিনি। তখন আমার ভেতরর কেউ বলে উঠলো, ‘কেন নয়? ক্যারিয়ারে নতুন পথে হাঁটার সময় হয়তো এখনই!’ ১০ বছর আমি ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলছি। অধিনায়ক হিসেবেও দলে কিছু যোগ করতে পারলে দারুণ হয়। হৃদয়ে এমন কোনো অনুভুতি নিয়ে আমি ক্যারিয়ার শেষ করতে চাই না যে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের জন্য সম্ভব সব কিছু করিনি।
আমি এখনও জানি না, কতটা কি করতে পারি; অধিনায়ক হিসেবে কতটা দিতে পারি। সময় গড়ালে হয়তো নিজের ও দলের কাছে ছবিটা পরিষ্কার হবে। আশা করি, যখন শেষ করব, আমার মেয়াদকে সফল বলতে পারব।
কিন্তু ২০১৩ সালে একবার আপনি ওয়ানডের অধিনায়কত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তখন কি তাহলে প্রস্তুত ছিলেন না?
আমলা: আমার স্রেফ মনে হয়েছিল, নেতৃত্ব নিয়ে কিছুই করার নেই আমার। ওয়ানডে দলের সহ-অধিনায়ক ছিলাম যখন, অধিনায়ক এবি ডি ভিলিয়ার্সের নিষেধাজ্ঞা ও চোটের কারণে সুযোগ এসেছিল। কিন্তু ওই সময়টায় মনে হয়েছিল, আমি অধিনায়কত্ব চাই না। ওই পর্যায়ে আমার আসলে ইচ্ছে হয়নি। এখন ভাবনা বদলেছে।
ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এই পর্যায়ে আপনার ব্যাটিং কতটা বিকশিত হয়েছে?
আমলা: আন্তর্জাতিক ক্রিকেট একটা কঠিন জায়গা। ২১ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করেছিলাম। এখন এমনকি চিন্তাও করতে পারি না ওই সময় কি ভাবতাম! ১১ বছর আগের কথা। তবে কেউ যদি খোলা মনের হয় আর সহায়ক অবকাঠামো ভালো থাকে, তাহলে ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিবর্তনটা সহজ হয়।
ওই সময়টায় আমি যা বুঝেছি, মাঠের ক্রিকেটে মানিয়ে নেওয়া খুব কঠিন কিছু না। কঠিন হলো, মাঠের বাইরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কিভাবে কাজ করে, সেটা বোঝা এবং ভিন্ন দলীয় আবহে মানিয়ে নেওয়া। সেটা যখন থেকে ধরতে শিখলাম, আমার ক্রিকেটও ভালো হতে শুরু করল। আর ব্যাটসম্যান হিসেবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সব সময়ই শেখার সময়। ক্যালিসের মতো অসাধারণ ক্রিকেটারের সঙ্গে খেললে, টেন্ডুলকার-দ্রাবিড়-পন্টিংদের মতো ক্রিকেটারদের বিপক্ষে খেললে নিজের ক্রিকেট আপনা-আপনি ভালো হয়।
সময়ের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন আপনি। দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বকালের সেরাদের একজন। পঞ্চাশকে শতকে রূপ দেওয়ার হার অবিশ্বাস্য। এই হার এত ভালোভাবে ধরে রাখেন কিভাবে?
১৬ বছর বয়সে আমি যখন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম খেলি, কল্পনাও করতে পারিনি দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ১১ বছর খেলব। আমি তাই চেষ্টা করি নিজেকে ও আমার ক্রিকেটকে এমনভাবে পরিচালনা করতে, যা আমাকে সাফল্যের সর্বোচ্চ সম্ভাবনা উপহার দেয়।
ওয়ানডেতে বেশ কটি রেকর্ডে আপনি ভিভ রিচার্ডসকে পেছনে ফেলেছেন। এটাকে কিভাবে দেখেন? ভিভকে মানা হয় আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের শেষ কথা।
আমলা: স্যার ভিভ সবসময়ই সত্যিকারের মাস্টার-ব্লাস্টার হিসেবে থেকে যাবেন। এমনকি যারা তাকে অনেক দূর থেকে দেখেছেন, তাদের কাছেও। ভিভের ধারে কাছে আসতে পারবে না কেউ। তার নামটা সবার ওপরে দেখতে আমি এমনকি হাসিমুখে আমার সব রেকর্ড বিসর্জন দিতে পারি। কারণ সবার ওপরে থাকাটাই তার প্রাপ্য।
ওয়ানডে ক্রিকেট খেলা সবসময়ই আনন্দের। ওয়ানডে খেলতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি আমি।
কিন্তু একটা সময় ওয়ানডেতে আপনার ব্যাটিং সামর্থ্য নিয়ে অনেকের সংশয় ছিল। ২০০৪ সালে টেস্ট অভিষেক হলেও ওয়ানডে অভিষেক হতে হতে ২০০৮ সাল।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝতে পেরেছি, লোকজনের কথা কোনো ব্যাপার নয়। এটা হলো আমার আর ক্রিকেট বলের ব্যাপার। বিভিন্ন ইস্যুতে লোকজনের মতামত আড়ালে রাখা এবং নিজের নিবেদনটাই হলো সাফল্যের মূল উপায়। আমি সেটাই চেষ্টা করেছি।
ওয়ানডেতে আপনার এখন এত এত রেকর্ড, টেস্টে ট্রিপল সেঞ্চুরি করা একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকান আপনি, উইজডেনের বর্ষসেরা হয়েছেন, আরও কত রেকর্ড-অর্জন। সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি দেয় কোনটি?
আমলা: টেস্ট সংক্রান্ত অর্জনগুলোই বেশি তৃপ্তি দেয়। বেড়ে ওঠার সময়টায় টেস্ট ক্রিকেটই ছিল আমার স্বপ্ন; সত্যিকারের লক্ষ্য। গত ৫-৬ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে জিততে থাকা একটি দলের অংশ হতে পারা দারুণ তৃপ্তির। ইংল্যান্ডে সিরিজ জয় ছিল, অস্ট্রেলিয়ায় ২০০৮ ও ২০১২ সালে জয়…দক্ষিণ আফ্রিকা এই কয় বছরে যা করেছে, খুব বেশি দল তা করতে পারেনি। ওই দলীয় অর্জনগুলোই আমার ক্যারিয়ারের হাইলাইটস।
হাশিম আমলা কি কখনও রাগ করেন?
আমলা: (হাসি) অবশ্যই…সবারই কখনও না কখনও রাগ হয়। হতাশা, দু:খ, খারাপ লাগা আসে। সবারই কোনো না কোনো পর্যায়ে রাগ হয়। তবে আমি ক্রিকেটারদের ওপর রাগ দেখাই না। ওদের ওপর রাগের কারণ নেই। দলে যে ১৫ জন আছে, কোনো সংশয়ই নেই যে তারা সবাই জিততে চায়। আর সব কিছুর ওপরে চায় ভালো করতে। সেরাটা দিতে চাইছে, এমন কারও ওপর রাগ করাটা তাই আমার উদ্ভট লাগে। তবে হারলে, পারফর্ম করতে না পারলে খারাপ লাগে। তবে সবাই তো সর্বোচ্চ চেষ্টাই করছে!
আমলা: বাংলাদেশ অবশ্যই উন্নতি করেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোয়। ফলই সেটার প্রমাণ; বিশেষ করে ঘরের মাঠে। তবে তাদের চ্যালেঞ্জ হবে বিদেশের মাটিতে। আমি নিশ্চিত, ওরাও সেটা মানবে।
তবে দেশের মাটিতে নিয়মিত জিতছে, এটাও দারুণ উন্নতির প্রমাণ। বিশেষ করে ওয়ানডেতে। ওয়ানডেতে ওদের অনেক অভিজ্ঞ ক্রিকেটার আছে। আমার এবং আমার দলের অনেকের চেয়েও অভিজ্ঞ। শুরুতেই যেটা বলেছি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যত বেশি খেলা যাবে, উন্নতি স্বাভাবিকভাবেই হবে। সেটাই হচ্ছে এখানে। বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটার এখন পরিণত, খেলাটা বুঝতে শিখছে। দেশের মাটিতে এজন্যই বাংলাদেশ নিয়মিত জিতছে।