ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সবুজ চত্বরে প্রিয় সখীর সঙ্গে গল্পে গল্পে সময় কাটানোর পাশাপাশি বয়সের ব্যবধান ছাড়িয়ে মিলনায়তনে নাচে-গানে উৎসবমুখর সময় কাটিয়েছেন বিভিন্ন দশকের শিক্ষার্থীরা।
দিনব্যাপী এই আয়োজনের শুরু শুক্রবার সকালে। টিএসসির সবুজ চত্বরে খোলা আকাশের নিচে জাতীয় সংগীত গেয়ে উত্তোলন করা হয় জাতীয় পতাকা, উড়ানো হয় বেলুন।
এরপর মিলনায়তনে শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
শিক্ষাবিদ হামিদা আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রকিব উদ্দিন আহমেদ, রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমা শাহীন, রোকেয়া হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রওশান আরা ফিরোজ ও সাধারণ সম্পাদক মরিয়ম বেগম।
এই অনুষ্ঠানের পরই শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনার প্রথম পর্ব। বিভিন্ন দশকের শিক্ষার্থীরা নিয়ে আসেন একক গান। স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে দেখা যায় অনেককে।
গান শুরু হওয়ার পরই তাতে কণ্ঠ মেলাতে থাকেন হলভর্তি শ্রোতা, বাড়তে থাকে মঞ্চে উপস্থিতিও; কিছুক্ষণের মধ্যেই তা পরিণত হয় সমবেত গান- সমবেত নৃত্যে। সংখ্যা বাড়তে থাকায় মঞ্চ গড়িয়ে সামনের খালি জায়গায়ও অবস্থান নেন নাচিয়েরা।
রবীন্দ্রনাথের ‘পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায় ও সেই, চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়?’ এর মাধ্যমে শেষ হয় এই পর্ব।
এরপর শুরু হয় স্মৃতিচারণ। দুপুরের খাবারের বিরতির আগে-পরে পুরনো দিনের কথা বলেন অ্যালামনাইদের কয়েকজন। এই পর্বে অংশ নিয়ে ১৯৬২ সালে প্রাণ রসায়ন থেকে পাস করা মুক্তিযোদ্ধা হাজেরা নজরুল শোনালেন তার জীবনের গল্প।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালে এখনকার রোকেয়া হল ছিল না। ছেলে-মেয়েদের মেলামেশা ছিল না।
“সবাই আমাদের বলত, ছেলেদের সঙ্গে মিশো না। আমরা বলতাম, আমরা পড়াশোনার আলাপই করছি। তবে আমাদের কারো প্রেম হয়নি। এভাবেই কেটে যায় বিশ্ববিদ্যালয় জীবন।”
যুদ্ধে স্বামী হারানো এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “গত ৪২ বছর যুদ্ধ করতে করতে আমি বুড়ো হয়ে গেছি। তবে নিঃশেষে প্রাণ দান করাই জীবনে স্বার্থকতা- সেভাবেই আমি বেঁচে আছি। গত তিনমাস আমি হসপিটালে ছিলাম।”
অর্ধশতক আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়া এই যোদ্ধা বয়সে প্রবীণ হলেও মনের দিক থেকে যে বুড়ো হননি সেটা বোঝালেন বক্তব্যের শেষে। হঠাৎ করেই তিনি গেয়ে উঠেন রবীন্দ্র সংগীত- ‘অনেক কথা বলেছিলেম কবে তোমার কানে কানে/কত নিশীথ-অন্ধকারে, কত গোপন গানে গানে॥’
অধ্যাপক মনোয়ারা ইসলাম বলেন, “হলের ছোট্ট পুকুরে আমরা নৌকা চালাতাম। হলের আম গাছ থেকে লুকিয়ে আম পেড়ে খেতাম। আমরা কয়েকজন গাছে উঠতে পারতাম। মেয়েরা আমাকে এ কারণে গেছো বলে ডাকত। রান্না ঘরেও আমাদের প্রবেশাধিকার ছিল না। আমরা সেখানে গিয়ে নানীদের কাছ থেকে নুন ও কাঁচা মরিচ নিয়ে খেতাম।”
উচ্ছ্বলতায় ভরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা হল থেকে পালিয়ে রূপমহলে বাংলা সিনেমা দেখতে যেতাম। সিনিয়র আপুরা আমাদের নিয়ে যেত। সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে হলে ফেরার তাড়ায় কোনো সিনেমার শেষ দেখতে পারতাম না।
“ক্লাস করার জন্য আমরা কমন রুমে গিয়ে অপেক্ষা করতাম। সেখান থেকে শিক্ষকের সঙ্গে ক্লাসে যেতাম। ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে প্রক্টরের অনুমতি লাগত।
“একবার একটি মেয়ে একটি ছেলের সঙ্গে কথা বলায় ছেলেটিকেসহ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় প্রক্টর অফিসে। তাদের নানাভাবে ধমক দেয়া হচ্ছিল। এরই এক পর্যায়ে মেয়েটি বলল, ও আমার আপন ভাই। টাকা দিতে এসেছিল।
“তবে এরমাঝেও প্রেম হত, তবে এখনকার মতো পাশাপাশি বসতেও পারত না। দূর থেকে একজন আরেকজনকে দেখত। তবে বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষে- এরকম ক্ষেত্রে দুইজনের নাম পাশাপাশি দেখা যেত।”
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুর পর ১৯৩৮ সালে ১২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে চালু হয় ছাত্রী হোস্টেল চামেলী হাউজ। ১৯৫৬ সালে এর নাম হয় উইমেন্স হল। এই ছাত্রী হোস্টেলই ১৯৬৪ সালে রোকেয়া হল নাম পায়।
রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বৃত্তিতে অ্যালামনাইদের অংশগ্রহণের কথা জানাতে মঞ্চে আসেন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মরিয়ম বেগম।
তিনি জানান, এই আয়োজনের শেষ হবে রাতে নৈশভোজের মাধ্যমে। সেই নৈশভোজ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা এই হলের সাবেক শিক্ষার্থী শেখ হাসিনার সৌজন্যে।
খাবারের জন্য তিনি পাঁচ লাখ টাকা পাঠিয়েছেন বলেও জানান মরিয়ম।