স্বীকৃতি পাচ্ছেন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা

ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে সনদের স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছেন দেশের কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2013, 04:18 PM
Updated : 11 August 2016, 09:25 AM

সরকার ‘বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ গঠন করে কওমী সনদের স্বীকৃতি দেয়াসহ মাদ্রাসাগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

বৃহস্পতিবার তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সনদের স্বীকৃতির জন্য কওমী শিক্ষার্থীদের দাবি যৌক্তিক। অবশ্যই তাদের সনদের স্বীকৃতি পাওয়া উচিত।”

সংশ্লিষ্ট আলেমদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ গঠন করে শিগগিরই স্বীকৃতির বিষয়টি বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানান তিনি।

দেশে সরকারনিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন আলিয়া মাদ্রাসার বাইরে প্রায় ২৫ হাজার কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। তবে এসব মাদ্রাসায় কত সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। বেসরকারিভাবে পরিচালিত এসব কওমি মাদ্রাসা মূলত ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে থাকে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, কওমি শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট একজন আলেমকে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এবং সাত আলেমকে এই কমিশনের সদস্য করা হবে। এছাড়া কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) পাঁচ শাখার পাঁচজন চেয়ারম্যান পদাধিকার বলে এই কর্তৃপক্ষের সদস্য হবেন।

সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার একজনকে এই কর্তৃপক্ষের সদস্য করা হবে। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ তাদের পছন্দমত একজনকে এই কর্তৃপক্ষের সদস্য সচিব হিসাবে নিয়োগ দেবেন।

ওই কর্মকর্তারা বলেন, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ কওমি মাদ্রাসার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের ডিগ্রীর স্বীকৃতি দেবে। কওমি মাদ্রাসার বিভিন্ন বোর্ডের কার্যক্রম সমন্বয় এবং পাঠ্যক্রম যুগোপযোগী করার কাজ করবে এই কর্তৃপক্ষ।

কর্তৃপক্ষকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে সরকার প্রস্তুত বলেও জানান তারা।

কওমি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ কওমি মাদ্রাসাগুলোর অ্যাফিলিয়েটিং হিসাবে কাজ করবে অর্থাৎ সদনের স্বীকৃতি পেতে হলে কওমি মাদ্রাসাগুলোকে অবশ্যই এই কর্তৃপক্ষের অধিভুক্ত হতে হবে। যেসব মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের অধিভুক্ত হবে না সেসব মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সনদের স্বীকৃতি পাবে না।

কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সনদের স্বীকৃতি পেলে বিভিন্ন চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবে। এছাড়া প্রতিযোগিতামূলক বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশ নেয়ারও সুযোগ পাবেন বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জানান।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, “কওমি নেছাব অনুসরণ করেই কওমী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করবে।”

প্রেক্ষাপট

বিগত চার দলীয় জোট সরকারের সময় থেকেই কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা তাদের সনদের স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছিল। বর্তমান সরকার গত বছরের ১৫ এপ্রিল কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বেফাকের সভাপতি ও চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও হেফাজতে ইসলামীর আমীর শাহ আহমদ শফীকে চেয়ারম্যান করে ১৭ সদস্যের কমিশন গঠন করে।

এই কমিশনের কো-চেয়ারম্যান হন শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। আর সদস্য সচিব করা হয় গোপালগঞ্জের গওহরডাঙা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ রূহুল আমীনকে। কিন্তু এই দুই জনকে সরকারসমর্থক বলে অভিযোগ করেন কমিশনের অন্য আলেমরা।

পরবর্তীতে কো-চেয়ারম্যান-১ পদে মাওলানা আশরাফ আলীকে ও সদস্য সচিব পদে আবদুল জব্বারের নাম দিয়ে কমিশন পুনর্গঠন করার দাবি জানান আহমদ শফী।

একই সঙ্গে বেফাকের নামে কওমি সনদের স্বীকৃতি দেয়া, বেফাককে অ্যাফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় করা, সরকারি অনুদান গ্রহণ না করা ও কওমি মাদ্রাসার পাঠপদ্ধতি পরিবর্তন না করাসহ আটটি প্রস্তাব তুলে ধরেন তিনি।

সরকারের সঙ্গে দুটি বৈঠকের পরেও এসব দাবি পূরণ না হওয়ায় আহমদ শফী কাউকে কিছু না জানিয়েই কমিশন থেকে ‘নিষ্ক্রিয়’ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে এই কমিশন তাদের প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।

এদিকে গত ৯ মার্চ শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে দেশজুড়ে হেফাজতে ইসলাম সংগঠিত হয়। ৬ এপ্রিল লংমার্চ ও ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আলোচনায় আসে সংগঠনটি।একই সঙ্গে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়েও বিভিন্ন ধরনের আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।

শিক্ষামন্ত্রী জানান, হেফাজতে ইসলামীর আমীরের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশের আলোকেই কওমি শিক্ষার্থীদের সনদের স্বীকৃতি দিতে এই কর্তৃপক্ষ গঠন করা হচ্ছে।

কওমি মাদ্রাসা নিয়ে যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত কওমি মাদ্রাসার আলেম-ওলামারাই নেবেন বলে শিক্ষানীতিতেও উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানান নাহিদ।

তিনি বলেন, “হেফাজতে ইসলামীর আমীরের নেতৃত্বাধীন কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছেন আমরা তারই অনুমোদন দিচ্ছি। কারণ দীর্ঘদিন থেকেই শিক্ষার্থীরা সনদের স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছিল। আর এটা তাদের ন্যায্য দাবি।”

আলেম-ওলামাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কওমী মাদ্রসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠন করে শিগগিরই তা মন্ত্রিসভায় তোলা হবে বলেও জানান মন্ত্রী।

কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রতিবাদ

কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন পাশের উদ্যোগের প্রতিবাদে হাটহাজারীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে হেফাজতে ইসলাম।

বৃহস্পতিবার বিকালের হাটহাজারী সদরের ডাক বাংলো চত্বরের এ সমাবেশ থেকে কওমি মাদ্রাসা ‘ধংসের এ ষড়যন্ত্র’ মানা হবে না বলেও ঘোষণা দেন হেফাজত নেতারা।

মিছিলের আগে অনুষ্ঠিত সমাবেশে টেলিফোনের মাধ্যমে বক্তব্য রাখেন হেফাজতে ইসলামের আমির ও হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফী।

বক্তব্যে আহমদ শফী বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিভিন্ন মহল ও বিশেষ কয়েকটি গণমাধ্যম কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে কথিত জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসকে জড়িয়ে চরম মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালাচ্ছে।

তিনি বলেন, “কওমি মাদ্রাসা দেশ ও সরকারবিরোধী নয়। বরং সহায়ক হিসেবেই কাজ করে যাচ্ছে। সুতরাং সরকারের নীতি নির্ধারকদের কাছ থেকে কওমি মাদ্রাসাবিরোধী পদক্ষেপ কোনো অবস্থাতেই জাতি আশা করে না।

কওমি মাদ্রাস শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন পাশের উদ্যোগের প্রতিবাদে দেশের প্রতিটি মাদ্রাসায় শুক্রবার দোয়া মাহফিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেন হেফাজতের আমীর।

হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর শামসুল আলমের সভাপতিত্বে সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় মহাসচিব হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদরিস, আহসান উল্লাহ, জাকারিয়া নোমান ফয়জী ও জাহাঙ্গীর আলম।

সমাবেশ শেষে মিছিলটি হাটহাজারী সদরের চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক, বাসস্ট্যান্ড, চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়ক, কলেজ গেট, কাচারি সড়ক প্রদক্ষিণ করে ডাক বাংলো চত্বরে এসে শেষ হয়।