গাছ কাটার পর বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ির মালিকানা বিতর্ক

‘শতবর্ষী গাছ’ কেটে ভবন নির্মাণের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ায় কাজ বন্ধ হওয়ার পর বিতর্ক এখন বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ির জমি নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ উভয়েই ওই স্থানের মালিকানা দাবি করছে।

মাসুম বিল্লাহসুলাইমান নিলয় ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 April 2016, 03:38 AM
Updated : 7 April 2016, 01:34 PM

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বর্তমানে দুটি পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে। একটি এফ রহমান হলের পাশে নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি, অন্যটি আনোয়ার পাশা আবাসিক এলাকা লাগোয়া, যেটি বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ি নামে পরিচিত।

বাবুপুরা ফাঁড়িতে গণপূর্ত অধিদপ্তর পুলিশের জন্য ২০ তলা একটি ভবন তৈরি করছে ৯ কোটি ৭৭ লাখ ৪০ হাজার ৮৮৮ টাকায়। প্রাথমিকভাবে একতলার কাজ শেষ করা হবে বলে প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে।

ভবন নির্মাণে গাছ কাটা শুরুর পর গত মাসের শেষ দিকে সমালোচনা আসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদকারীদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক।

তিনি গত ২৯ মার্চ তিনটি শতবর্ষী রেইন ট্রি গাছ কেটে ফেলার তথ্য জানিয়ে পরদিন ফেইসবুকে স্ট্যাটাস তিনি। আশপাশে থানা থাকায় নীলক্ষেত ও বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ি থাকার যৌক্তিকতা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন।

সামাজিক মাধ্যম থেকে এই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ রাস্তায় চলে আসে। এরই মধ্যে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা বেশ কয়েকবার বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। এর মধ্যেই জোরালো হয় পুলিশ ফাঁড়ি সরিয়ে নেওয়ার দাবি।

বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ি এলাকায় সোমবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ১০ থেকে ১৫টি ছোট-বড় গাছ কেটে টুকরা করে রাখা হয়েছে। গাছের অনেক গুঁড়ি সরিয়ে নেওয়ার কথাও জানান সেখানকার এক কর্মচারী।

তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত এক সপ্তাহ ধরে এখানকার কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ আছে।”

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশের মত, থানা থেকে দূরবর্তী এলাকার জন্য পুলিশ ফাঁড়ির দরকার হয়। এখন আর ক্যাম্পাসে পুলিশ ফাঁড়ির প্রয়োজন নেই।

দীর্ঘদিন থেকেই এই দুই স্থানে পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে, ১৯৭৬ সালে রমনা থানা গঠিত হলে এ দুটি ছিল তারই অধীন। ২০০৬ সালে শাহবাগ থানা গঠিত হলে ক্যাম্পাস এলাকা শাহবাগ থানায় পড়ে। অন্যদিকে ২০০৫ সালে নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির রাস্তার বিপরীতে নিউ মার্কেট থানা ভবন হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিউ মার্কেট থানার কয়েকগজের মধ্যে নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি রাখার কোনো প্রয়োজন এখন নাই। সেখানে তো এখন সম্পূর্ণ একটি থানা হয়ে গেছে।”

“আবার বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ির জায়গায় ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা-ই জানান দিচ্ছে, সেটার কার্যকারিতা আর দেখছে না পুলিশ বাহিনীও।”

অধ্যাপক ফরিদ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার প্রয়োজনে পুলিশকে ওই জায়গা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন তারা ওই স্থানের মালিকানা দাবি করছে। শতবর্ষী অনেক গাছ কেটে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে চাইছে।”

দুই পুলিশ ফাঁড়ি থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দীরও।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেখানে ফাঁড়ি থাকারই যৌক্তিকতা নেই সেখানে পুলিশের ভবন নির্মাণের ‘চক্রান্ত’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক স্বায়ত্তশাসন ও শিক্ষার পরিবেশের জন্য হুমকি।”

ঢাকা মেডিকেল থেকে গুলিস্তানগামী রাস্তার উত্তরপাশে বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ি। এর পশ্চিম-উত্তর-পূর্ব পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন রয়েছে। এর মাঝেই দেয়াল ঘেরা একটি খোলামেলা জায়গায় টিনশেড ব্যারাক ভবনে চলছিলো পুলিশ ফাঁড়ির কার্যক্রম।

জায়গাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বলেই মনে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা ও সম্পত্তি দেখভালকারী এস্টেট বিভাগের ব্যবস্থাপক সুপ্রিয়া দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৬১ সালের পাকিস্তানের গভর্নর আজম খানের কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়কে যে জমি বুঝিয়ে দিয়েছিল, তাতে এ জায়গাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু পুরোনো মানচিত্রেও ফাঁড়িটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় দেখানো আছে।

“তবে এই জমি বুঝিয়ে দেওয়ার আগ থেকে জায়গাটিতে ফাঁড়িটি ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার স্বার্থে এখান থেকে পুলিশ ফাঁড়িটি সরানো হয়নি। তার মানে এই নয় যে, জমিটি পুলিশের।”

এই ফাঁড়ির বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (এস্টেট) শোয়েব রিয়াজ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৩৪ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তর পুলিশকে জমিটি বরাদ্দ দেয়। সিএস এবং আরএস রেকর্ডে এটি পুলিশের নামে রয়েছে। জমিটা তাই পুলিশের।

“আজম খান কমিশন জমিটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু তাতে তো মালিকানা বদলে যায় না। তাদের জমিটা প্রয়োজন হলে তারা পুলিশের কাছ থেকে নিতে পারতেন, সরকারকে দিয়ে একুইজিশন করিয়ে নিতে পারতেন। কিছুই কিন্তু করেননি। তাই জমির মালিকানা পুলিশের।”

ভবন নির্মাণের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের আরবরি কালচার বিভাগ এবং বন বিভাগের অনুমতি নিয়েই এই গাছ কাটা হয়েছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

“ঢাকায় ভবন নির্মাণ করতে হলে সেখানে যদি গাছ থাকে তাহলে কাটতে হবে। তবে এরজন্য নিয়ম আছে। বন বিভাগের অনুমতি নেওয়ার সময়, তারা দেখে, দুর্লভ কোনো গাছ থাকলে তারা লে আউট চেইঞ্জ করতে বলে। সেই অনুমোদন নিয়েই আমরা গাছ কেটেছি।”

কাছাকাছি এলাকায় থানা থাকায় ক্যাম্পাসে ফাঁড়ির প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা দেখছেন না বলে জানানো হলে শোয়েব রিয়াজ বলেন, “থানা আর ফাঁড়ির কাজ তো এক না। টহল দেওয়া হয় ফাঁড়ি থেকে। আর থানা সাধারণত তদন্তের কাজ করে।

“আর ফাঁড়ি সরিয়ে কোথায় নেব? যেখানে আমার একটা জায়গা আছে। কেন ভবন নির্মাণ করতে পারবে না? ওখানে বিশ্ববিদ্যালয়েরও দুইটা ভবন আছে।”

পুলিশ ফাঁড়ি কোন এলাকায় স্থাপন করা হয়- এ প্রশ্নে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জনগুরুত্বপূর্ণ ও থানার আয়তনের কথা চিন্তা করে ফাঁড়ি করার সিদ্ধান্ত হয়।

“এক্ষেত্রে কোনো একটা বড় স্থাপনা আছে, কোনো অপরাধপ্রবণ এলাকা- এসব চিন্তা করেও ফাঁড়ি হয়। ফাঁড়ি করতে পুলিশ সদর দপ্তর প্রস্তাব দিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে একনেকে যায়। সেখানে সিদ্ধান্ত হলে ফাঁড়ি করা হয়।”

একই ভবনে ফাঁড়ি এবং থানা একত্রে থাকার নজিরও রয়েছে বলে জানান মনিরুল।

জায়গার মালিকানার বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের(পিডব্লিউডি) রমনা উপ-বিভাগের প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পিডব্লিউডি থেকে এই জায়গাটি তাদের (পুলিশ) দেওয়া হয়েছিল। যদি তাদের মালিকানা না থাকত, তাহলে তারা এই ভবন নির্মাণ করতে পারত না।”

অন্যদিকে ফাঁড়ি থাকার প্রয়োজনীয়তা দেখলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় এই ধরনের উঁচু ভবন নির্মাণ ‘ঠিক হবে না’ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফাঁড়িগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার জন্যই ব্যবহার হয়। ফাঁড়িটা আরও কার্যকর করার জন্য একতলা কিংবা দোতলা ভবন তারা নির্মাণ করতে পারে। কিন্তু উচ্চ ভবন নির্মাণ করা ঠিক হবে না।”

জায়গার মালিকানা দাবি করে উপাচার্য বলেন, “আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনে নীলক্ষেত ও বাবুপুরায় ফাঁড়ির জন্য জায়গা দিয়েছি। এটা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়েরই জায়গা।”