কুক্ষিগত হল আইজিডব্লিউ ব্যবসা

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের বিরোধিতার পরও শেষ পর্যন্ত সাত আইজিডব্লিউর হাতে আন্তর্জাতিক কল পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়েছে বিটিআরসি, যার মধ্য দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর একচেটিয়া কারবারের ছকই বাস্তবায়িত হল বলে অভিযোগ উঠেছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2015, 03:58 PM
Updated : 26 March 2015, 08:02 AM

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি মঙ্গলবার এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা জারি করে বলেছে, এখন থেকে আন্তর্জাতিক কল পরিচালনার কাজে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন এই ‘নেটওয়ার্ক টপোলজি’ অনুসরণ করতে হবে।

আইজিডব্লিউ, আইসিএক্স ও মোবাইল অপারেটরদের (এএনএস) ৩০ দিনের মধ্যে এই নেটওয়ার্ক টপোলজি অনুযায়ী কল আদান প্রদানের ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ ব্যবস্থায় নেটওয়ার্ক টপোলজির নিয়ন্ত্রণ পাওয়া সাতটি আইজিডব্লিউর অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ফলে বাকি আইজিডব্লিউগুলো বন্ধের উপক্রম হবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা।

টেলিকম অপারেটররা বলছে, এ ব্যবস্থায় অবৈধ ভিওআইপি উৎসাহিত হবে; সরকার ও মোবাইল কোম্পানিগুলো বঞ্চিত হবে শত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে।

বিটিআরসি ও সাত আইজিডব্লিউর সঙ্গে মঙ্গলবার এক বৈঠকে এ উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরেন মোবাইল ফোন কোম্পানির প্রতিনিধিরা।    

বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার আগে বিটিআরসির একাধিক কর্মকর্তা ও আইজিডব্লিউ ব্যবসায়ী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সরকারি দলের কয়েকজন নেতা মিলে এ পরিকল্পনা তৈরি করেছেন। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানাতেও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা আছেন। অনেকটা চাপে পড়েই বিটিআরসিকে তাতে সায় দিতে হয়েছে।

দেশে মোট ২৯টি ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে অপারেটর থাকলেও তাদের সংগঠন ‘আইওএফ’ এর মধ্যে থেকে সাত আইজিডব্লিউ আন্তর্জাতিক কল পরিচালনায় কর্তৃত্ব পাচ্ছে।

এই সাত প্রতিষ্ঠান হল- ইউনিক ইনফোওয়ে, ডিজিকন টেলিকমিউনিকেশনস, রুটস কমিউনিকেশনস, গ্লোবাল ভয়েস, মীর টেলিকম, বাংলা ট্র্যাক ও নভো টেলিকম।

বিটিআরসি বলছে, নতুন এই পদ্ধতি বাণিজ্যিকভাবে চালুর আগে আইওএফ বিটিআরসিকে অবহিত করবে। এরপর বিটিআরসি সরেজমিন পরিদর্শন করে বাণিজ্যিকভাবে চালুর অনুমোদন দেবে।

পরীক্ষামূলকভাবে এ পদ্ধতি চালু করার জন্য কীভাবে আন্তঃসংযোগ প্রতিস্থাপন করতে হবে- সেই  কারিগরি বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছে বিটিআরসি। 

এ ব্যবস্থায় ইন্টারন্যাশনাল লং ডিসটেন্স কমিউনিকেশন (আইএলডিসি) অর্থাৎ সাবমেরিন কেবল বা আইটিসি সরাসরি সংযুক্ত থাকবে আইওএফ এর কমন ইন্টারন্যাশনাল পয়েন্ট বা সিআইপির সঙ্গে। আইজিডব্লিউগুলো কল আদান প্রদান করবে সিআইপির মাধ্যমে।

অর্থাৎ, কোনো আইজিডব্লিউ সরাসরি আইএলডিসি অপারেটরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না। তারা সরাসরি কোনো অপারেটরের সঙ্গে কল আদান প্রদানও করতে পারবে না। এ কাজটি তাদের করতে হবে ওই সাত আইজিডব্লিউ অপারেটর সুইচ (আইওএস) এর মাধ্যমে।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে অপারেটরস ফোরাম (আইওএফ) নামে এই সংগঠন তৈরির প্রস্তাবে সায় দিয়ে তা অনুমোদনের জন্য ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পাঠায় বিটিআরসি।

লাইসেন্স নীতিমালা অনুযায়ী, আইজিডব্লিউগুলো একই লাইসেন্সের আওতায় থাকার কথা থাকলেও এ পরিকল্পনায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুটি অসম স্তরে ভাগ করা হয়, যার টিয়ার-১ এ ১৬টি এবং টিয়ার-২ এসাতটি প্রতিষ্ঠান রাখা হয়।

২৮ সেপ্টেম্বর বিটিআরসি টিয়ার-২ এ আইওএস সুইচ পরিচালনাকারী ওই সাত আইজিডব্লিউর নাম চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পরে মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন দেয়। ওই সাত প্রতিষ্ঠানকেই এখন একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বলে অন্যদের অভিযোগ।

পরিকল্পনা মডেল অনুযায়ী, বৈদেশিক কল আদান-প্রদানের সব লেনদেন হবে ‘টিয়ার-২’ এর একটি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে। অন্য অপারেটর কল আদান-প্রদানের সব অর্থ হস্তান্তর করবে টিয়ার-২ এর মাধ্যমে। পরে টিয়ার-২ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের (বিটিআরসি, আইসিএক্স ও এএনএস) কাছে রাজস্ব হস্তান্তর করবে।

পরিকল্পনায় টিয়ার-১ ও টিয়ার-২ এর লভ্যাংশ ভাগাভাগির হার ধরা হয়েছে ১:১.৯০। একই ব্যবসা হলেও টিয়ার-২ এর প্রায় দ্বিগুণ আর্থিক লাভ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, টিয়ার-১ যদি পায় এক টাকা, তাহলে টিয়ার-২ পাবে এক টাকা ৯০ পয়সা।

বিটিআরসি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কোটি মিনিটের আন্তর্জাতিক কলের বাজার রয়েছে।

ক্ষতির শঙ্কা

নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই সিদ্ধান্তের ফলে ক্ষতির শঙ্কায় থাকা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইন্টারন্যাশনাল লং ডিসটেন্স টেলিকমিউনিকেশন সার্ভিস পলিসিতে ( আইএলডিটিএস) তিন স্তরে (আইজিডব্লিউ, আইসিএক্স ও এএনএস) কল আদান প্রদানের কথা বলা হলেও নতুন ব্যবস্থায় তা মানা হয়নি।  নীতিমালা সংশোধন না করেই নতুন একটি স্তুর যুক্ত করে এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, যাতে মুক্ত প্রতিযোগিতার শর্তও ভঙ্গ হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিটিআরসি পরীক্ষামূলকভাবে এই নেটওয়ার্ক টপোলজি বাস্তবায়নের কথা বললেও এর সময় নির্ধারণ করে দেয়নি। ফলে পুরো বিষয়টি এখন নিয়ন্ত্রণ পাওয়া সাত প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যাচ্ছে।

বিটিআরসির নির্দেশনা ও নতুন পরিচালন পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে রাজস্ব ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা বোঝার চেষ্টা করেছে দেশের একাধিক মোবাইল ফোন অপারেটর। 

এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, নতুন প্রক্রিয়া চালুর পর প্রতিমাসে মোবাইল অপারেটররা  ১৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা, আইসিএক্সগুলো ১৬ কোটি টাকা, বিটিআরসি প্রায় ৪৭ কোটি টাকা রাজস্ব বাবদ হারাবে।

অন্যদিকে আইজিডব্লিউগুলোর লাভ মাসে ৭০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৪০ কোটি টাকা হবে। সবচেয়ে বেশি লাভ পাবে নিয়ন্ত্রণকারী সাত প্রতিষ্ঠান।

বিটিআরসির নির্দেশনায় বলা হয়েছে, আইওএসগুলো আইসিএক্স এর রাজস্ব নিশ্চিত করতে ব্যাংক গ্যারান্টি দেবে। নেটওয়ার্ক টপোলজি অনুযায়ী এ কার্যক্রম চালু করার আগেই বিটিআরসির রাজস্ব নিশ্চিত করতে ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হবে।

সরকারের রাজস্ব সঠিক সময়ে পরিশোধ না করলে আইওএফ কর্তৃপক্ষ ট্রাফিক/কল ব্লক করে দেবে এবং ব্যাংক গ্যারান্টি নগদায়ন বা বকেয়া রাজস্ব আদায়ের পদক্ষেপ নেবে।

তবে অপারেটরদের আর্থিক নিরাপত্তার দিকটি বিটিআরসি এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়নি। গত বছর আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অপারেটরদের বকেয়া থাকা কমপক্ষে ১৪০ কোটি টাকা আদায়ের বিষয়েও বিটিআরসির নির্দেশনায় কিছু বলা হয়নি।

একটি মোবাইল অপারেটরের একজন কর্মকর্তা বলেন, “এ নির্দেশনা শুধু একটি অংশকে লাভবান করার জন্য করা হয়েছে। এর ফলে এ সেক্টরে একটি অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হবে।”

আইওএস একটি আলাদা সেবা হলেও কোনো ধরনের লাইসেন্স ছাড়াই এ প্রক্রিয়া চালু হচ্ছে। কল আদান-প্রদানের জন্য অপারেটররা কেবল ওই সাত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই চুক্তি করতে পারবে। তবে কোন আইনের ভিত্তিতে সেই চুক্তি হবে তা স্পষ্ট নয় অপারেটরগুলোর কাছে।

এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোসের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। অন্য কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অপারেটররা জানান, ২০১২ সালের অগাস্টে পাকিস্তানেও একই ধরনের পরিচালন ব্যবস্থা চালু করা হয়, যা নিয়ে সে সময় তুমুল বিতর্ক হয়। পরে গতবছর জুনে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সরকার ওই নির্দেশনা স্থগিত করে।