হরতালের ওপর ইউরোর ঘা: সংকটে রপ্তানি

অবরোধ-হরতাল আর ইউরোর দর পতনে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Feb 2015, 06:18 PM
Updated : 22 Feb 2015, 06:30 PM

এক বছর আগে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা জার্মানির বাজারে ১০০ ইউরো মূল্যের এক ডজন পোশাক রপ্তানি করে দশ হাজার ৭০০ টাকা পেতেন; এখন পাচ্ছেন আট হাজার ৮৫০ টাকা।

অথচ ছয় মাস আগে এই একই পরিমাণ পোশাক রপ্তানি করে পাওয়া যেত দশ হাজার ৩০০ টাকা।

রপ্তানিকারক এবং অর্থনীতিবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, টানা অবরোধ-হরতালে এমনিতেই হুমকির মুখে পড়েছে রপ্তানি খাত। এরপর ইউরোর ধারাবাহিক দর পতনে তা বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এক বছর আগে (২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি) ইউরো-টাকার বিনিময় হার ছিল ১০৭ টাকা। অর্থ্যাৎ এক ইউরোর জন্য লাগতো ১০৭ টাকা।

রোববার এক ইউরোর বিনিময় মূল্য ছিল ৮৮ টাকা ৫০ পয়সা, ছয় মাস আগে (২০১৪ সালের ২২ অগাস্ট) যা ছিল ১০৩ টাকা।

অন্যদিকে এক বছর আগে ডলার-ইউরোর বিনিময় হার ছিল ১ দশমিক ৪ ডলার। অর্থ্যাৎ এক ইউরোর জন্য লাগত এক ডলার ৪০ সেন্ট। এখন এক ডলার ১৪ সেন্টেই পাওয়া যায় এক ইউরো।

ছয় মাস আগে এক ইউরোর জন্য খরচ করতে হতো এক ডলার ৩২ সেন্ট।

শতকরা হিসাবে গত ছয় মাসে টাকার বিপরীতে ইউরোর মান কমেছে ১৬ শতাংশ। আর এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ২১ শতাংশ।

অর্থ্যাৎ এক বছরে ইউরোর বিপরীতে টাকা ২১ শতাংশ শক্তিশালী হয়েছে। ছয় মাসে শক্তিশালী হয়েছে ১৬ শতাংশ।

এ সব তথ্য পর্যালোচনা করে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বিডিনউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মরার উপর খাড়ার ঘা হয়েছে আমাদের। হরতাল-অবরোধ-সহিংস রাজনীতিতে এমনিতেই আমরা দিশেহারা।এরসঙ্গে ইউরোর অব্যাহত দরপতনে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে আমাদের রপ্তানি।”

‘বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশের বেশি ইউরোতে আসে’- এ তথ্য দিয়ে পারভেজ বলেন, “ইউরোপের বাজারগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্য ছাড়া জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালি, নেদারল্যাল্ডসহ অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ইউরোতে ব্যবসা হয়ে থাকে। তবে আমাদের অন্যতম বড় বাজার যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ডলারেই লেনদেন হয়ে থাকে।”

“সহিংস রাজনীতিতে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। বায়াররা নতুন অর্ডার দিচ্ছে না। আগের অনেক অর্ডারও বাতিল করে দিচ্ছে। এরসঙ্গে কমছে ইউরোর দাম। সবমিলিয়ে আমরা বড় বিপদের মধ্যে পড়ে গেছি। বড় ধরনের নেগেটিভ ইফেক্ট পড়বে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে।”

‘তবে টেক্সটাইল খাতের জন্য ভালো হচ্ছে’ জানিয়ে এই পোশাক রপ্তানিকারক বলেন, “এই সব দেশ থেকে আমাদের টেক্সটাইল খাতের প্রয়োজনীয় যে সব মেশিনারি আমদানি হয় তার বিল ইউরোতে মেটানোয় ব্যয় কম হচ্ছে।”

ইউরো জোনের এই দেশগুলোতে নিট পোশাক এবং সোয়েটার বেশি রপ্তানি হয় বলে জানান পারভেজ।

নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাত-আট মাস আগেও আমরা ১০০ ইউরোর রপ্তানি করে দশ হাজার ৮০০ পেতাম। এখন পাচ্ছি আট হাজার ৩০০ টাকা। আগে ১ ইউরো রপ্তানি করে যে টাকা পেতাম এখন তা পেতে ১ দশমিক ২ ইউরোর পোশাক রপ্তানি করতে হচ্ছে।”

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডলার-টাকা উভয়ের বিপরীতেই ইউরো দুর্বল হচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব আমাদের রপ্তানি খাতে পড়ছে।

শুধু তৈরি পোশাক নয় ইউরো জোনে অন্য পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে জানান অর্থনীতির এই গবেষক।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আমাদের মোট রপ্তানি আয়ের ৩০ শতাংশের বেশি আসে ইউরোপের বাজারগুলো থেকে। এরমধ্যে ২০ শতাংশের বেশি আসে ইউরো মুদ্রায় লেনদেন হওয়া ইউরো জোনের দেশগুলো থেকে।

মূলত: গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই ইউরো জোনে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। আর তার কারণেই মার্কিন ডলারসহ অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে দুর্বল হচ্ছে ইউরো।

চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন হাজার ৩২০ কোটি (৩৩ দশমিক ২০ বিলিয়ন) ডলার।

এরমধ্যে সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) আয় হয়েছে এক হাজার ৭৮০ কোটি (১৭ দশমিক ৮০ বিলিয়ন) ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ০৬ শতাংশ বেশি।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩০ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় দেশে এসেছিল, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি।