হরতাল-অবরোধ নিষিদ্ধের দাবি ব্যবসায়ীদের

হাতে পতাকা আর কণ্ঠে জাতীয় সংগীত নিয়ে সারা দেশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নেতিবাচক রাজনীতি বন্ধ ও আইন করে হরতাল-অবরোধ নিষিদ্ধের দাবি জানালেন ব্যবসায়ীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Feb 2015, 06:43 AM
Updated : 8 Feb 2015, 12:21 PM

বিএনপি জোটের টানা অবরোধের ৩৩তম দিন রোববার বেলা ১২টা থেকে দেশের প্রতিটি জেলায় ব্যবসায়ী চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের সামনে ১৫ মিনিটের এই কর্মসূচি হয়।

ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে মতিঝিলে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি (এফবিসিসিআই) কার্যালয়ের সামনে পতাকা হতে এই মানববন্ধনে অংশ নেন ব্যবসায়ীরা।

গত ৫ জানুয়ারি থেকে সারা দেশে বিএনপি জোটের লাগাতার অবরোধের মধ্যেই দফায় দফায় হরতালে দেশের অর্থনীতির ক্ষতির একটি চিত্র কাজী আকরাম তার বক্তব্যে  তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, সাময়িক হিসেবে গত ৩৩ দিনে ৭৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে পরিবহন খাতে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, পোশাক খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকা, উৎপাদন খাতে ৪ হাজার কোটি টাকা, পর্যটন খাতে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, কৃষি ও পোল্ট্রি খাতে ৯ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা, হিমায়িত পণ্য খাতে ২৫০ কোটি টাকা, আবাসন খাতে ৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় ১৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

“প্রকৃতপক্ষে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি। চলমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের উদ্যোগ সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যার কোনো পরিমাপ করা যায় না।”

এ অবস্থা চলতে থাকলে অবিলম্বে আইন করে হরতাল অবরোধ ‘সম্পূর্ণভাবে’ নিষিদ্ধ করাসহ পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনের এই নেতা।

তিনি বলেন, “দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল, এ রকম সময়ে এই রাজনৈতিক সহিসংতা।... দেশের স্বার্থে অর্থনীতির স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর সংঘাত ও নেতিবাচক কর্মসূচি, বিশেষ করে হরতাল-অবরোধ পরিহার করা জরুরি।”

এফবিসিসিআই এর দাবিগুলোর মধ্যে হরতাল-অবরোধ চলকালে ক্ষতিগ্রস্ত সব ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফ, বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ গ্রহীতাদের ঋণ পুনর্গঠনের যে সুযোগ দিয়েছে তা সব ব্যবসায়ীকে দেওয়া এবং ‘সহিংসতা ও জ্বালাওপোড়াও’ বন্ধের দাবিও রয়েছে।

কাজী আকরাম বলেন, “আমরা এমন একটি সময়ে এখানে সমবেত হয়েছি যখন অবরোধ-হরতালের নামে দেশে এক ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। চোরাগোপ্তা হামলার মাধ্যমে চলন্ত যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও পেট্রেল বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এতে শুধু প্রাণহানির ঘটনাই ঘটছে না, অনেকেই সারা জীবনের জন্য শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যাচ্ছেন। এর সাথে বিশাল ক্ষতির শিকার হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতি। আমরা এর অবসান চাই।”

অবরোধ-হরতালে জানমালের ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, “চলমান সহিংসতায় ৮৭ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে শিশুও রয়েছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে আছে ২০০ জন। এক হাজার গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে, চার হাজার গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে, এক হাজারের বেশি ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে, ১০টি স্থানে রেলে নাশকতা করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন অফিস-আদালত, ব্যবসা কেন্দ্রে হামলা হয়েছে।”

এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে বেলা ১১টার পর থেকেই ব্যবসায়ীরা যার যার সংগঠনের ব্যানার নিয়ে মতিঝিলের দিকে আসতে থাকেন। তারা দৈনিক বাংলা মোড় থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত এলাকায় রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডারের পাশে অবস্থান নেন।

এ সময় তাদের হাতে দেখা যায় ছোট ছোট জাতীয় পতাকা। তাদের ব্যানারে লেখা দেখা যায়- ‘সবার উপরে দেশ, দেশ বাঁচাও, অর্থনীতি বাঁচাও’; ‘জানমালের নিরাপত্তা চাই, ব্যবসার পরিবেশ চাই’সহ বিভিন্ন স্লোগান।

ঠিক ১২টায় এফবিসিসিআই ভবনের সামনে বসানো মঞ্চ থেকে মাইকে বাজানো হয় জাতীয় সংগীত। ব্যবসায়ীরা এ সময় হাতের পতাকা তুলে ধরে কণ্ঠ মেলান- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’ 

জাতীয় সংগীত শেষে এফবিসিসিআই সভাপতি লিখিত বক্তব্য দেন। সংগঠনের সাবেক সভাপতি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুণ, সালমান এফ রহমান, মীর নাসির হোসেন, আনিসুল হক, এ কে আজাদ, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি হোসেন খালেদ, বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম, এমসিসিআইর সাবেক সভাপতি রোকেয়া আফজাল রহমানসহ এফবিসিসিআইয়ের পরিচালনা পর্যদের সদস্য এবং ব্যবসায়ীদের প্রধান সংগঠনগুলোর নেতারা এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।

কাজী আকরামের বক্তব্য শেষে আবারও জাতীয় সংগীত বাজিয়ে কর্মসূচির সমাপ্তি টানা হয়। 

দেশের ৭৪টি চেম্বার ও ৩৬৯টি ব্যবসায়ী সমিতি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত একযোগে এ কর্মসূচি পালন করে বলে বলে এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

একই সময়ে হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবনের সামনে জাতীয় পতাকা হাতে রাজপথে মানববন্ধন করেন তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের এ কর্মসূচিতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কারওয়ান বাজারের আড়ৎদার, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অংশ নেন।

বিজিএমইএর সহ-সভাপতি এসএম মান্নান কচি বলেন, “আমরা হরতাল অবরোধের মতো বিধ্বংসী কর্মসূচি দেখতে চাই না। শান্তি চাই, সরকারের কাছে ব্যবসা বাণিজ্যের নিরাপত্তা চাই। হরতাল অবরোধে দেশের অর্থনীতির রক্ত ঝরছে।”

সারা দেশেই ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলো পতাকা হাতে এই মানববন্ধন করেছে বলে আমাদের জেলা প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ঘনঘন হরতাল-অবরোধের‘ প্রতিবাদে ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর ব্যবসায়ীরা সারা দেশে সাদা পতাকা হাতে যে মানববন্ধন করেছিলেন, যদিও সে সময় তাদের আহ্বানে সাড়া দেননি রাজনৈতিক নেতারা।

গত ১ ফেব্রুয়ারি আবারও একই ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করে কাজী আকরাম জানান, পতাকা হাতে মানববন্ধনের পর ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে তারা রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি দেবেন।

গত ১০ জানুয়ারি কাজী আকরাম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, সংলাপের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। এবার আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে না। সম্ভব হলে তারা আইনি পদপেক্ষ নেবেন।

এ বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে পাঁচজন শীর্ষ আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনাও করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এর আগে কাজী আকরাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “আইনি পথে প্রতিকার চাওয়ার বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় আছে। আমরা আশা করি অবরোধের বিরুদ্ধে একটা প্রতিকার পাওয়া যাবে। ভারতীয় আদালতে ‘বন্ধ’ এর বিরুদ্ধে রায় আছে।”