হল-মার্কের ‘সন্দেহজনক’ টাকা ট্রান্সকমে

অর্থ লোপাটে অভিযুক্ত হল-মার্ক গ্রুপের কর্ণধার তানভীর মাহমুদের কাছ থেকে দেশের শীর্ষ দুটি দৈনিক পত্রিকার এক মালিক ‘বিপুল অর্থ নিয়েছেন’ বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গোয়েন্দাদের দেয়া এক প্রতিবেদন হাতে নিয়ে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

রিয়াজুল বাশারও সালাহউদ্দিন ওয়াহিদ প্রীতমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Oct 2014, 10:40 AM
Updated : 9 Oct 2014, 10:37 AM

প্রতিবেদনে অর্থ স্থানান্তরের গতিপথকে সন্দেহজনক বলা হয়েছে।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দারা অনুসন্ধানে জানতে পেরেছেন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সকম গ্রুপের পরিচালক সাইফুর রহমানের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে সাড়ে ১৬ কোটি টাকা জমা হয়েছে, যে অর্থ এসেছে তানভীর এবং তার স্ত্রী ও বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামের কাছ থেকে।

মিডিয়াস্টার ও মিডিয়া ওয়ার্ল্ড নামে দুটি কোম্পানির অধিকাংশ শেয়ারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ট্রান্সকম গ্রুপের হাতে। এই দুটি কোম্পানির মালিকানায় প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা দৈনিক প্রথম আলো ও ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার।

সাইফুর রহমান ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লতিফুর রহমানের ভাই।

সাইফুর রহমানের পাঁচটি ব্যাংক হিসাবের লেনদেন তথ্য পর্যালোচনা করে আর্থিক গোয়েন্দারা তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, “সার্বিক পর্যালোচনায় পরিলক্ষিত হয়, হল-মার্ক ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে জনাব সাইফুর রহমানের একাধিক ব্যক্তিগত হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছে।”

অবশ্য ট্রান্সকম গ্রুপের দাবি, হল-মার্কের কাছে সাইফুর রহমানের পৈত্রিক জমি বিক্রির অর্থই তার অ্যাকাউন্টে গেছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দাদের তৈরি করা প্রতিবেদনটি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়েছে, যার একটি অনুলিপি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে দুদক কমিশনার এম শাহাবুদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হল-মার্কের বিষয়ে দুদকের মামলা চলছে। প্রপার্টি রিলেটেড একটা নতুন বিষয় এসেছে। ইতোমধ্যে এর অনুসন্ধানও কমিশন শুরু করেছে।”

আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি লোপাটের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় হল-মার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম জামিনে থাকলেও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ গত প্রায় দুবছর ধরে কারাগারে।

ট্রান্সকম গ্রুপ মূলত বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে তা দেশে বিক্রি করে। গত দু’দশকের বেশি সময় ধরে তারা মিডিয়া বাণিজ্যেও সক্রিয়।

মিডিয়া স্টারের অধীনে রয়েছে বাংলা দৈনিক প্রথম আলো এবং মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর কাছ থেকে কিনে নেয়া এবিসি রেডিও।

মিডিয়া ওয়ার্ল্ডের মালিকানায় চলছে ডেইলি স্টার ও সাময়িকী সাপ্তাহিক ২০০০।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, “জনাব সাইফুর রহমানের বিভিন্ন ব্যাংকে পরিচালিত হিসাবসমূহে তানভীর মাহমুদ, জেসমিন ইসলাম এবং হল-মার্কের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ববি স্পিনিং মিলস লিমিটেড থেকে মোট ১৬ দশমিক ৬২ কোটি টাকা জমা হয়েছে।

“জমাকৃত অর্থের একাংশ এফডিআর করাসহ পূর্বাচল এলাকায় ৭ দশমিক ৫ কাঠা ও পাঁচ কাঠা আয়তনের দুটি জমি ক্রয় বাবদ স্থানান্তর করা হয়।

“অবশিষ্ট অর্থ সিকিউরিটিজ এবং বিভিন্ন ব্যক্তি হিসাব ও প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হয়।”

গোয়েন্দারা সন্দেহ প্রকাশ করে মত দিয়েছেন, “সামগ্রিক বিচারে হল-মার্ক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হতে স্থানান্তরিত অর্থ জনাব সাইফুর রহমানের এক হিসাব হতে অন্য হিসাবে এমনভাবে স্থানান্তরিত হয়েছে যাতে অর্থের গতিপথ অনুসন্ধানে জটিলতার সৃষ্টি হয় যা মানি লন্ডারিংয়ের ভাষায় লেয়ারিং মর্মে প্রতীয়মান হয়।”

এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে ট্রান্সকম কার্যালয়ে যোগাযোগ করে সাইফুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তার ম্যানেজারের মোবাইল নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর ট্রান্সকম গ্রুপের আইন বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ফোন করে এ বিষয়ে কথা বলেন।

তিনি বলেন, “সাইফুর রহমানের পৈত্রিক জমির কাছেই হল-মার্ক গ্রুপের অফিস। আমরা ওদের কাছে জমি বিক্রি করেছি। ওই জমিগুলো বিক্রি করতে গিয়েই টাকাগুলো আমাদের কাছে এসেছে। এর রেজিস্ট্রার্ড ডিড আমাদের কাছে আছে, সেল ডিডও আমাদের কাছে আছে।”

ফখরুজ্জামান বলেন, “শুনে আমার কাছে যে রকম মনে হয়েছে যে, টাকা সাইফুর রহমান সাহেবের অ্যাকাউন্টে হল-মার্ক বা ববি স্পিনিং মিল থেকে এসেছে, কিন্তু টাকাটা যে আমাদের জমি বিক্রি থেকে এসেছে সেই কথাটা প্রতিবেদনে নেই।”

তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের সঙ্গে সাইফুর রহমানের কর দেয়ার হিসাব মিলিয়ে দেখলেই অর্থ স্থানান্তরের কারণ স্পষ্ট হয়ে যাবে। 

রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংক থেকে হল-মার্ক গ্রুপের প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা লোপাটের খবর ২০১২ সালের মে মাস থেকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সারাদেশে এ নিয়ে আলোচনা শুরুর পর ২০১২ সালের মাঝামাঝি থেকে এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন।

সাইফুর রহমান

অনুসন্ধান শেষে ওই বছরই অক্টোবরে জেসমিন ইসলাম ও তানভীর মাহমুদসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে ১১ টি মামলা করে দুদক। মামলা দায়েরের এক বছর পর জেসমিন ও তানভীরসহ ২৫ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন।

সাইফুর রহমান ও হল-মার্কের লেনদেন পর্যালোচনা

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দাদের ‘বিশেষ প্রতিবেদন’ এর ভূমিকায় বলা হয়েছে, জেসমিন ইসলাম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদের ব্যক্তিগত হিসাব থেকে সাইফুর রহমানের ব্যক্তিগত হিসাবে ‘বিপুল’ অর্থ স্থানান্তর হওয়ার কারণ অনুসন্ধানের জন্য আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট থেকে সাইফুর রহমানের ডাচ-বাংলা ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংকের বনানী শাখা, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মতিঝিল শাখা, প্রাইম ব্যাংকের গুলশান শাখা এবং এইচএসবিসি ব্যাংকে পরিচালিত হিসাবগুলোর তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়।

ডাচ-বাংলা ব্যাংক

আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট সাইফুর রহমানের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বনানী হিসাবে নয়টি লেনদেন তথ্য পর্যালোচনা করেছে; যে লেনদেনগুলো হয়েছিল ২০১০ সালের চার অগাস্ট থেকে ২০১২ সালে এক মার্চের মধ্যে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হল-মার্ক গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ববি স্পিনিং মিলস থেকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে দুই কোটি ৩১ লাখ টাকা জমা হয় সাইফুর রহমানের ব্যক্তিগত হিসাবে, যা থেকে পরবর্তীতে একই শাখায় এক কোটি টাকা মূল্যমানের এফডিআর করা হয়।

“এছাড়া তানভীর মাহমুদ ও মিসেস জেসমিন ইসলামের ব্যক্তি হিসাবসমূহ হতে মোট তিন কোটি ১২ লাখ টাকা জনাব সাইফুর রহমানের ব্যক্তি হিসাবে জমা হয় যা হতে বৃহৎ অঙ্কের অর্থ মেসার্স নিমবাস লি. এবং জনাব নুরা আলম এর হিসাবে জমি ক্রয় বাবদ প্রদান করা হয়।”

ঢাকা ব্যাংক

ঢাকা ব্যাংকের লেনদেন পর্যালোচনা করে গোয়েন্দারা বলেছেন, জেসমিন ইসলাম ও তানভীর মাহমুদের রোকেয়া সরণীর হিসাব থেকে দুই কোটি ও এক কোটি ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের দুটি পে অর্ডার সাইফুর রহমানের নামে ইস্যু করা হয়। এ পে অর্ডার ডাচ বাংলা ব্যাংকের গুলশান শাখায় সাইফুর রহমানের সঞ্চয়ী হিসাবে ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ঢাকা ব্যাংকের বনানী শাখায় দুই কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক

২০১১ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ২০১২ সালের ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় সাইফুর রহমানের চলতি ও সঞ্চয়ী দুটি হিসাবে ২২টি লেনদেন তথ্য পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সাইফুর রহমানের দুটি হিসাবে বিভিন্ন লেনদেনের মাধ্যমে হল-মার্ক ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান হতে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।”

২০১১ সালের ২২ এপ্রিল ববি স্পিনিং মিলসের জনতা ব্যাংকের মতিঝিল শাখার হিসাব থেকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে দুই কোটি ৩১ লাখ টাকা সাইফুর রহমানের হিসাবে জমা হয়।

এই জমার আগে সাইফুর রহমানের হিসাবে স্থিতি ছিল ১৪ লাখ ৫১ হাজার টাকা। ববি স্পিনিংয়ের পে অর্ডার জমা হওয়ার ২১ দিন পরই সাইফুর রহমানের হিসাব থেকে এক কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয় ইমতিয়াজ হুসেইন সিকিউরিটিজ লিমিটেডের হিসাবে।

২০১২ সালের ২২ জানুয়ারি হল-মার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামের ঢাকা ব্যাংকের হিসাব থেকে পাঁচ কোটি ৩৮ লাখ টাকা সাইফুর রহমানের হিসাবে জমা হয়।

এর পরদিনই ইমতিয়াজ হুসেইন সিকিউরিটিজ লিমিটেডের হিসাবে এক কোটি টাকা এবং তার পরদিন চার কোটি ৩৮ লাখ টাকা একই ব্যাংকে সাইফুর রহমানের সঞ্চয়ী হিসাবে জমা করা হয়।

চারদিন পর আরো এক কোটি টাকা ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রগতি শাখার গ্রাহক মেসার্স শিকাজু ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস এর হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।

এইচএসবিসি ব্যাংক

ঢাকা ব্যাংকের আমিন বাজার শাখায় তানভীর মাহমুদের ছয়টি হিসাব থেকে ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সব অর্থ নগদে উত্তোলন দেখানো হয়। একই তারিখে সাইফুর রহমানের এইচএসবিসির হিসাবে তানভীর মাহমুদ সাড়ে তিন কোটি টাকা পে অর্ডার করেছেন।

প্রাইম ব্যাংক

প্রাইম ব্যাংকের গুলশান শাখায় সাইফুর রহমানের সাতটি এফডিআর হিসাবের মধ্যে পাঁচটি হিসাবে নগদে অর্থ জমা হওয়ার উৎস সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি।