‘বিমান পরিবহন সংস্থা, না মুদি দোকান?’

ইউনাইটেড এয়াওয়েজের ফ্লাইট পরিচালনা নিয়ে তিন দিনের ‘নাটক’ এবং শেয়ারের দরপতনের পর শঙ্কায় পড়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা, যে কোম্পানি পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ার ধারণের শর্তও পূরণ করেনি।

রিয়াজুল বাশারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2014, 09:28 AM
Updated : 30 Sept 2014, 11:40 AM

ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ পাবলিক কোম্পানি হওয়ার পর গত চার বছরে পুঁজিবাজার থেকে চারশ কোটি টাকার বেশি অর্থ তুলে নিয়েছে। কিন্তু চেয়ারম্যানের পদত্যাগ ও তিন দিন ফ্লাইট বন্ধ থাকার পর অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বাজার মূলধন ৬৭০ কোটি টাকা থেকে কমে ৬১৯ কোটি টাকায় ঠেকেছে।

শেয়ারের দাম কমতে কমতে অভিহিত মূল্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়েছেন ইউনাইটেডের শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা।

মোহাম্মদ আসলাম হোসেন নামের একজন বিনিয়োগকারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানি হঠাৎ করেই কীভাবে ফ্লাইট বন্ধ বা চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়? ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে বিনিয়োগ করে এখন বিপদে পড়েছি।”

এ অবস্থায় ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ‘প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি’ শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের মধ্যে থেকে পরিচালক নিয়োগ করে পর্ষদ পুর্নগঠন এবং কোম্পানির স্বচ্ছতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি এইমস অব বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ইয়াওয়ার সায়ীদ।

ইউনাইটেড এয়ারের সার্বিক বিষয় তদন্তে রোববার একটি কমিটি গঠন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেছেন, কমিটিকে আগামী ২১ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ২০০৫ সালে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে বিমান পরিচালনা করার লাইসেন্স দেয়। তার দুই বছর পর যাত্রী পরিবহন শুরু করে ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ।

প্রতিষ্ঠানটি শুরুতে শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। পরের বছরই রাইট শেয়ার ইস্যু করে তুলে নেয় আরো ৩১৫ কোটি টাকা।

কিন্তু কোম্পানির পরিচালকরা তাদের হাতে থাকা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার পরে বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে দেন।

ফাইল ছবি

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, এ কোম্পানির প্রায় ৭৪ শতাংশ শেয়ার আছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ১৭ শতাংশ। আর ইউনাইটেডের পরিচালকদের হাতে আছে মাত্র ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ শেয়ার।

পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে ২০১১ সালে প্রতিটি কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। আর পর্ষদে থাকা পরিচালকদের হাতে থাকতে হবে কোম্পানির অন্তত ২ শতাংশ শেয়ার।

ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ক্ষেত্রে এর কোনোটিই পূরণ হয়নি।

নিয়ম অনুযায়ী পরিচালকদের হাতে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার না থাকলে কোনো কোম্পানি রাইট শেয়ার ইস্যু করতে পারে না। ওই নির্দেশ প্রতিপালন না করে উল্টো নিয়ম শিথিল করারও আবেদন করেছিল ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ, যদিও বিএসইসি তাতে সাড়া দেয়নি।

২০১২ সালে ডেফার্ড ট্যাক্স সংযুক্ত করে আয়ের হিসাব দেখিয়েও বিতর্কে জড়ায় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। এতে আয় বেশি দেখানো হচ্ছে উল্লেখ করে আপত্তি জানায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ।

এরই মধ্যে গত ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে হঠাৎ করেই ইউনাইটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থপানা পরিচালক তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরীর পদত্যাগ এবং নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিয়োগের তথ্য জানানো হয় কোম্পানির পক্ষ থেকে।

নতুন ব্যবস্থাপকরা দায়িত্ব নেয়ার পরপরই অর্থাভাবের কথা বলে ইউনাইটেডের সব ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে এক দিকে টিকেট কাটা যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েন, অন্যদিকে পুঁজিবাজারে অনিশ্চয়তায় পড়েন বিনিয়োগকারীরা।

এই পরিস্থিতিতে ইউনাইটেডের শেয়ার বিক্রির হিড়িক পড়ে গেলে সোমবার এ কোম্পানির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের দাম ১০ টাকায় ৯০ পয়সায় ঠেকে। অথচ এর রাইটস শেয়ার ইস্যু করা হয়েছিল ১৫ টাকায়।

তিন দিন ফ্লাইট বন্ধ থাকার পর তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী গত শুক্রবার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ফিরে আসায় আবার ফ্লাইট চালুর ঘোষণা দেয় ইউনাইটেড। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের অস্বস্তি তাতে কাটেনি।

সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি এইমস অব বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ইয়াওয়ার সায়ীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটা লোক না থাকলে সব বন্ধ হয়ে যাবে? একটা লোকের সইয়ে সব টাকা উঠবে, একটা লোকের নামে প্লেন উড়বে; এটা কি মুদি দোকান নাকি”

কোম্পানির সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তিনি বলেন, “এতো কম শেয়ার নিয়ে বোর্ডে বসার অধিকার  নেই। তাই ফ্লাইট বন্ধের মতো সিদ্ধান্তও এরা নিতে পারেন না।”

ইয়াওয়ার সায়ীদ মনে করেন, কোম্পানি পরিচালনার ক্ষেত্রে কর্পোরেট গর্ভনেন্স নিশ্চিত করা না গেলে নৈরাজ্য থামবে না।

অবশ্য ইউনাইটেড এয়ারের ইস্যু ব্যবস্থাপক এএএ কনসালটেন্ট অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল অ্যাডভাইজরের পরিচালক মোহাম্মদ এ হাফিজ মনে করছেন, ধাক্কা

সামলে ওঠার মতো ভিত্তি ইউনাইটেডের রয়েছে।

“আমার ধারণা, এতোবড় কোম্পানি… অসুবিধা হবে না। এদের এয়ারক্রাফটগুলো আছে। আগের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও ফিরে এসেছেন।”

গত সাত বছরে মাঝারি ও ছোট আকারের ১১টি পুরনো উড়োজাহাজ কিনেছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, যার মধ্যে ছয়টিই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে গ্রাউন্ডেড। উড়োজাহাজের অভাবে ইউনাইটেডের ফ্লাইট সূচি ঠিক রাখতে না পারা এবং যাত্রীসেবার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বরাবরই।

চলতি আর্থিক বছর শেষে প্রতিষ্ঠানটি ৫৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা মুনাফা দেখিয়েছে, যদিও তৃতীয় প্রান্তিকের আর্থিক বিররণীতে দেনা দেখানো হয়েছে ২০০ কোটি টাকার বেশি।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছেও প্রতিষ্ঠানটির বকেয়া রয়েছে ৮৪ কোটি টাকা। কয়েক দফা সময় দেয়ার পরও তা পরিশোধ না করায় ইউনাইটেডের লাইসেন্স বাতিলেরও হুমকি দিয়েছিল বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।

প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অব্যবস্থাপনার বিষয়টি এর অন্যতম পরিচালক শাহিনুর আলমের কথায়ও উঠে এসেছে।

তাসবিরুলের পদত্যাগের পর টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে গত বৃহস্পতিবার শাহিনুর সাংবদিকদের বলেন, বোর্ড মিটিংয়ে একটি অ্যাকাউন্টের হিসাব নিয়ে কথা ওঠায় পরই হঠাৎ পদত্যাগ করেছিলেন তাসবিরুল।

এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ চেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারী আসলাম হোসেন বলেন, “বিনিয়োগকারীদের রক্ষার জন্য কোম্পানির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার। আমরা চাই, বিএসইসি এসব বিষয় সঠিকভাবে দেখভাল করুক।”

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, “ইউনাইটেড এয়ারের ব্যবসায়িক কার্যক্রম হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা, দুই দিন পর তা পুনরায় চালুর ঘোষণা, পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন ও অস্বাভাবিক হারে শেয়ারের দরপতনের কারণসহ সার্বিক সব বিষয়ই পর্যবেক্ষণ করবে আমাদের তদন্ত কমিটি।”