যুক্তরাষ্ট্র ‘মুখ ফেরাচ্ছে’, শঙ্কায় পোশাক রপ্তানিকারকরা

গত তিন মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বাজারে তৈরি পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় বাজার হারানোর আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা।

প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Sept 2014, 05:00 PM
Updated : 15 Sept 2014, 05:00 PM

বিভিন্ন দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কর্মপরিবেশ নিয়ে পশ্চিমাদের অসন্তোষের মধ্যে সোমবার এক সভায় এই আশঙ্কার কথা জানান তারা।

রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে এই মতবিনিময় সভায় বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনিসুর রহমান সিনহা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এর মধ্যেই বাংলাদেশের বিকল্প বাজার খুঁজতে শুরু করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে ইন্দোনেশিয়া সম্প্রতি বাংলাদেশকে টপকে গেছে জানিয়ে এই আশঙ্কার সঙ্গে একমত পোষণ করেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের প্রধানতম এই সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি আতিকুল ইসলামও।

ওপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান সিনহা বলেন, “গত ছয় মাস ধরে আমাদের পোশাক রপ্তানি কমছে। আমাদের ব্যবসা অন্য দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে। আমাদের অন্যতম প্রধান বাজার আমেরিকা এখন আফ্রিকার দেশগুলোকে বিকল্প বাংলাদেশ বানানোর চেষ্টা করছে।”

এই চেষ্টার অংশ হিসেবে কেনিয়া, ইথিওপিয়া ও উগান্ডাসহ অফ্রিকার দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় কারখানাগুলোর একটির এই মালিক।

“ইউরোপও আমেরিকার সঙ্গে যোগ দিয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ, রাস্তা-ঘাটসহ আমরা যদি আমাদের অন্যান্য সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান না করি, তাহলে আমাদের তৈরি পোশাক খাতের অবস্থা পাটের মতো হবে।”

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল পাট ও পাটজাত দ্রব্য। কিন্তু বর্তমানে পাট রপ্তানি ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে গেছে। এর বিপরীতে প্রধান রপ্তানি পণ্য হিসেবে উঠে এসেছে তৈরি পোশাক, যা থেকে বছরের ২২০০ কোটি ডলার আয় হয়।

তবে তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক এবং রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক পোশাক শ্রমিক মারা যাওয়ার পর বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে উদ্বিগ্ন পশ্চিমা দেশগুলো।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র তাদের বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা বাতিল করে। তৈরি পোশাক এই শুল্কমুক্ত সুবিধা না পেলেও ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আগে থেকে করা হচ্ছিল।

বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক রপ্তানির বাজারে আমরা আমাদের শেয়ার কিছুটা হারিয়েছি। বাংলাদেশকে টপকে উপরে উঠে গেছে ইন্দোনেশিয়া।

“যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন চতুর্থ অবস্থানে। গত ফেব্রুয়ারিতেও ছিল তৃতীয়। এটি আমাদের জন্য একটি দুশ্চিন্তার বিষয়।”

ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলসের (ওটেক্সা) তথ্য তুলে ধরে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি এখন ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।

“ভারত বড় আকারে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ঢোকার কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়েছে। আর ভিয়েতনামে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে সেখানকার পোশাক পণ্যে বৈচিত্র্য এসেছে। গত ছয় মাসে আমেরিকার বাজারে ভিয়েতমানের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ।”

“আমেরিকার বাজার নিয়ে আমাদের মধ্যে একটি উদ্বেগ কাজ করছে,” বলেন পোশাক শিল্প মালিকদের এই নেতা।

আতিকুল বলেন, গত তিন মাস ধরে তৈরি পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমছে। গত ২৩ মাসের মধ্যে জুলাই মাসে উভেন পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ।

শ্রমিকদের মজুরি, পরিবহন খরচ, ব্যাংক ঋণের সুদের হারসহ অন্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় কারখানার গড় উৎপাদর খরচ ১৩ শতাংশ বেড়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ২৫ শতাংশের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র।

চার মাসের রপ্তানির তথ্য উপস্থাপন করে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, চলতি বছরের মে মাসে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ, গত বছরের মে মাসে যা ছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। জুন মাসে ২১ শতাংশ থেকে কমে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ০৭ শতাংশ। গত বছরের জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৬ দশমিক ১৩ শতাংশ। অগাস্ট মাসে ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ২৩ শতাংশে নেমে এসেছে।

আতিকুল বলেন, “অথচ জুলাই মাসে ভারতে ১৩ দশমিক ৩১ শতাংশ এবং ভিয়েতনামে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। পাকিস্তান, ভারত ও ভিয়েতনাম সবাই এগিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।”

অবকাঠামো সমস্যার কথা তুলে ধরে ১০ বছর ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেইনে উন্নীত করার কাজ শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিজিএমইএ সভাপতি।

“গ্যাস পাচ্ছি না, ডিজেল দিয়ে কারখানা চালাতে হচ্ছে। বন্দরে পণ্য পাঠাতে ১০ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগছে। নানা ধরনের ষড়যন্ত্র তো আছেই। সব মিলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি।”

ডিসেম্বরে ঢাকায় ‘অ্যাপারেল সামিট’

আতিকুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরতে ডিসেম্বরে ঢাকায় ‘অ্যাপারেল সামিট’ আয়োজন করা হয়েছে। ৭ থেকে ৯ ডিসেম্বর এ সামিট অনুষ্ঠিত হবে।

গুলশানে আমারি হোটেলে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় পোশাক শিল্প মালিকদের মধ্যে বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস এবং আনিসুল হকও বক্তব্য রাখেন।

সাংবাদিকদের মধ্যে মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মুনয়েম, ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, যমুনা টেলিভিশনের বার্তা প্রধান জাকারিয়া কাজল, একাত্তর টেলিভিশনের পরিচালক (বার্তা) ইশতিয়াক রেজা, মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক রেজওয়ানুল হক রাজা বক্তব্য রাখেন।