২০ বিলিয়ন ডলারের এই খাতের ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ মনে করেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ থেকে সরকারকে চাপে ফেলতেই যুক্তরাষ্ট্র এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে সরকার সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা চুক্তির খসড়া অনুমোদন করায় এখনো আলোচনার পথ খোলা রয়েছে বলেও মত দিয়েছেন পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর একজন সাবেক সভাপতি।
সাম্প্রতিক সময়ে তারজীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজা ধসে ১২ শ’র বেশি শ্রমিক নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে কারখানার কর্ম পরিবেশের উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের পণ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি মাইকেল ফ্রোম্যান এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।
জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্সেসের (জিএসপি) আওতায় বাংলাদেশ পাঁচ হাজার ধরনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি করতে পারত।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, “জিএসপি নিয়ে অনেক দিন ধরেই শুনানি চলছিল। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের কর্মপরিবেশ উন্নত করার কথা বলেছে। আমরা তা করছিও। সরকার শ্রম আইন সংশোধন করছে। এছাড়া কারখানার কর্ম পরিবেশ ও শ্রমিকদের জীবন-মান উন্নয়নে আমরা কাজ করছি। এসব বিষয় যুক্তরাষ্ট্রকে বিভিন্নভাবে জানানোও হয়েছে।”
তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে না বলেই মনে করেন বিজিএমইএ সভাপতি।
“বিশ্বের অন্যান্য বাজারে হয়তো আমরা চাপের মধ্যে পড়ব। তবে রপ্তানি কমে যাওয়ার মতো কিছু ঘটবে না।”
নিট পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহ-সভাপতি মো. হাতেমের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যে সময়ে এসে যেভাবে জিএসপি স্থগিত করল- তা ‘অন্যায়’।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তারা কর্মপরিবেশ ও শ্রম মান নিয়ে যে কথা বলছে তা ঠিক না। আমরা আইএলওকে সঙ্গে নিয়ে কর্মপরিবেশ ও শ্রম মান উন্নয়নে কাজ করছি।”
যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন হাতেম।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশকেন্দ্রীক কিছু রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে চাপে ফেলতে ওবামা প্রশাসন জিএসপি স্থগিত করেছে।”
এই ‘রাজনৈতিক’ বিষয়গুলো কি- তা স্পষ্ট না করলেও আরেকজন ব্যবসায়ী নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার দীর্ঘ দিন ধরেই তাগিদ দিয়ে আসছে। জিএসপি সুবিধা বাতিলের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতেও এ প্রসঙ্গ এসেছে।
“এছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূস প্রসঙ্গে এবং রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ছিল। সব বিষয় মাথায় নিয়েই হয়তো যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের সিদ্ধান্ত দিয়েছে।”
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে, ২০১১-১২ অর্থবছরের বাংলাদেশ মোট রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে মোট রপ্তানির ২১ শতাংশ (প্রায় ৫০০ কোটি ডলার)।
পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, যেসব বাংলাদেশি পণ্য এতোদিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা পেয়ে আসছিল, সেগুলোর সিংহভাগই ইপিজেড থেকে রপ্তানি হয়। আর এসব পণ্যের রপ্তানিকারক বিদেশি বিনিয়োগকারিরা। ইপিজেডের বাইরে দেশের রপ্তানিকারকরা ‘সামান্য কিছু পণ্য’ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেন।
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বড় ব্যবসায়িক অংশীদার। সিঙ্গেল কান্ট্রি হিসেবে সেখানে আমরা ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করি। এ রকম পার্টনার কান্ট্রি থেকে নেতিবাচক যে কোন সিদ্ধান্ত আমাদেরকে চাপে ফেলবে।”
তাজরীণ ও রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর দেশের তৈরি পোশাক খাতকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত সেই চাপকে আরও বাড়িয়ে দেবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা চুক্তির বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেন।
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি বলেন, “যা কিছু সুবিধা আদায় করার তা সরকারকেই করতে হবে। সম্প্রতি টিকফা চুক্তির খসড়া সরকার অনুমোদন করেছে। আলোচনার দ্বার এখনও খোলা আছে। সরকারের এখন আলোচনার উদ্যোগ নেয়া উচিৎ।”