উচ্চগতির ইন্টারনেট প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ

দেশের ২৬০০ ইউনিয়নে উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে ‘ইনফো সরকার-৩’ প্রকল্পের কাজ দুটি কোম্পানিকে দেওয়ার উদ্যোগে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 August 2017, 02:43 PM
Updated : 23 August 2017, 05:23 PM

সংগঠনটির অভিযোগ, গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার কার্যাদেশ আইএসপিকে না দিয়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে দুটি এনটিটিএনকে (নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক) দেওয়ার প্রস্তাবে ‘মারাত্মক ঝুঁকিতে’ পড়তে যাচ্ছে এ খাত।

বুধবার ঢাকার একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করে আইএসপিএবির সভাপতি এম এ হাকিম তাদের অভিযোগ ও আশঙ্কার বিষয়গুলো তুলে ধরেন।

তবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের দাবি, অনিয়মের অভিযোগ সঠিক নয়, এ নিয়ে বিভ্রান্তিরও সুযোগ নেই। 

গতবছর ২৩ ডিসেম্বর একনেকের অনুমোদন পাওয়া ‘ইনফো সরকার-৩’ প্রকল্পের আওতায় সরকার ২০১৮ সালের মধ্যে ২ হাজার ৬০০ ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারকে ফাইবার অপটিক ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলকে (বিসিসি); ব্যয় ধরা হয়েছে মোট এক হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা।

আইএসপিএবির সভাপতি হাকিম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত ৯ অগাস্ট সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ প্রকল্পের জন্য দুটি ক্রয়প্রস্তাব অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়।

এর ফলে প্রতিষ্ঠান দুটি সরকারি খরচে ইউনিয়নগুলোতে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপন করার কার্যাদেশ পাবে এবং সরকার নির্ধারিত মূল্যে দুই লাখ সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার সুযোগ পাবে।

সব চূড়ান্ত হলে সামিট কমিউনিকেশনস ও ফাইবার অ্যাট হোম মোট ৩৭৮ কোটি ৪৬ লাখ ৫৬ হাজার টাকায় এ কাজ করবে।

আইএসপিএবি বলছে, প্রকল্পটির দরপত্র আহ্বান, দরপ্রস্তাব মূল্যায়ন, কার্যাদেশ অনুমোদনের সুপারিশ এবং কার্যাদেশপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কাজের আওতা নির্ধারণে চারটি সুনির্দিষ্ট অনিয়ম হয়েছে।

তাদের প্রথম অভিযোগ, একনেক আটটি পর্যায়ে দরপত্র আহ্বানের অনুমতি দিলেও সেই সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে দুটি পর্যায়ে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ওই দুই পর্যায়ে দরপত্র জমা দিয়েছে কেবল দুটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সামিট কমিউনিকেশনসকে এক হাজার ৩০৭টি এবং ফাইবার অ্যাট হোমকে এক হাজার ২৯৩টি ইউনিয়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

লিখিত বক্তব্যে এম এ হাকিম বলেন, “একনেকের পূর্ব-অনুমোদন ব্যতিত, দুটি প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার্থে আটটির স্থলে দুটি প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান বিসিসির এখতিয়ার বহির্ভূত এবং সরকারের কার্যপ্রণালি-বিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন।”

দুটি দরপত্রের কার্যাদেশ দুই প্রতিষ্ঠান ‘ভাগাভাগি করে নিয়েছে’- এমন দাবি করে দ্বিতীয় অভিযোগে হাকিম বলেন, ১৩০৭টি ইউনিয়নের কাজের জন্য একটি কোম্পানি ১৮৯ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার ২৭১ টাকার দর প্রস্তাব দিয়েছে। আর ১২৯৩টি ইউনিয়নের কাজের জন্য অন্য কোম্পানি ১৮৮ কোটি ৫২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৮৫ টাকার দরপ্রস্তাব দিয়েছে।

“দুটি এনটিটিএন প্রতিষ্ঠান সমঝোতার ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নেওয়ায় এক্ষেত্রে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার কোনো সুযোগ ছিল না, যা গণখাতে ক্রয়-আইন ক্রয়-বিধিমালার সাথে সাংঘর্ষিক।”

টেলিযোগাযোগ আইন অনুযায়ী এনটিটিএ লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং এএনএসের (অ্যাকসেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস) কাছে ভাড়া দেওয়ার এখতিয়ার রাখে। আর গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার দায়িত্ব এখতিয়ার এএনএস প্রতিষ্ঠানগুলোর।

কিন্তু কার্যাদেশ পেলে এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলো এখতিয়ার না থাকার পরও গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে বলে তৃতীয় অভিযোগে জানিয়েছে আইএসপিএবি।

চতুর্থ অভিযোগে হাকিম বলেন, এ দরপত্রের আওতায় ২০ বছরের জন্য কার্যাদেশ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। অথচ এনটিটিএন কোম্পানিগুলো  লাইসেন্স পেয়েছে ১৫ বছরের জন্য। শর্ত অনুযায়ী, লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান তাদের লাইসেন্সের মেয়াদের বাইরে কোনো চুক্তি করতে পারে না।

সুষ্ঠু তদন্ত করে এসব ‘অনিয়ম’ ঠেকানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাওয়া হয় আইএসপিএবির সংবাদ সম্মেলনে।

অন্যদের মধ্যে আইএসপিএবির সাধারণ সম্পাদক মো. ইমদাদুল হক ও সহ-সভাপতি এফ এম রাশেদ আমিন বিদ্যুৎ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা কেউ কথা বলতে চাননি। পরে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) পক্ষ থেকে একটি লিখিত বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে পাঠানো হয়।

প্রথম অভিযোগের জবাবে বিসিসি বলছে, দুটি পর্যায়ে দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ সঠিক নয়।

“এনটিটিএনদের বিদ্যমান নেটওয়ার্কের উপর ভিত্তি করে কাজের সুবিধার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে আটটি প্যাকেজকে দুটি প্যাকেজে রূপান্তর করা হয়েছে।”

এ রূপান্তরে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটানো হয়নি দাবি করে বিসিসি বলেছে, পরবর্তীতে ডিপিপি সংশোধনের সময় এটি সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

যোগসাজশের মাধ্যমে কাজ ভাগ করে নেওয়ার অভিযোগের জবাবে বিসিসি বলেছে, উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট দরদাতাই দর নির্ধারণ করে থাকে। দরপত্র আহ্বান ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় পিপিআর ২০০৮ এর বিধি-বিধান অনুসরণ করা হয়েছে এবং অনুমোদনের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।

কার্যাদেশ দেওয়া হলে এনটিটিএন প্রতিষ্ঠান দুটি এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে সেবা দেওয়ার সুযোগ পাবে বলে যে অভিযোগ আইএসপিগুলো করছে, তাও সঠিক নয় বলে কম্পিউটার কাউন্সিলের ভাষ্য।

বিসিসি বলছে, বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী এনটিটিএন প্রতিষ্ঠান আইএসপিদের কাছে ব্যান্ডউইথ বিক্রি করে এবং আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা দেয়। ‘ইনফো সরকার- তৃতীয় পর্যায়’ প্রকল্পের আওতায় ইউনিয়ন পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম অনুসরণ করা হবে। এখানে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই।

“এনটিটিএন প্রতিষ্ঠান দুটি ২০ বছর অপটিক্যাল ফাইবার কেবল রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত, আপগ্রেডেশনসহ অন্যান্য সেবা প্রদান করার প্রস্তাব করেছে। পরবর্তীতে সকল বিধি-বিধান অনুসরণ করে সরকার নির্ধারিত মূল্যে এনটিটিএন প্রতিষ্ঠান দুটি আইএসপিদের কাছে ব্যান্ডউইথ বিক্রয় করবে।”

যোগসাজশের মাধ্যমে কাজ ভাগাভাগির অভিযোগের বিষয়ে সামিট কমিউনিকেশনস ও ফাইবার অ্যাট হোমের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।