তথ‌্যপ্রযুক্তি: সরকারের নীতি বদলই হবে সবচেয়ে বড় ভর্তুকি

এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ের কাজ এগিয়ে নিতে বিভিন্ন দেশের সরকারি নীতি আরও সহজ করার পরামর্শ এসেছে বিমসটেকের একটি গোলটেবিল আলোচনায়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 March 2017, 12:01 PM
Updated : 6 March 2017, 01:15 PM

তথ‌্যপ্রযুক্তি নীতি গবেষণায় যুক্ত লার্নেশিয়ার জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো আবু সাঈদ খান বলছেন, বেসরকারি খাতের কাজে সরকারি ভর্তুকির প্রয়োজন হবে না। এই খাতে নীতি পরিবর্তনই হবে কোনো দেশের সরকারের সবচেয়ে বড় ভর্তুকি। এশিয়ার দেশগুলোতে সরকারি নীতির সমন্বয়ই সবচেয়ে জরুরি।

“সরকারি নীতি পরিবর্তন এশিয়ার তথ‌্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো ঘাটতির ৪০ শতাংশ মিটিয়ে দিতে পারে। বেসরকারি খাত বাকিটা করে নেবে।”

সোমবার ঢাকার গুলশানে বিমসটেক সচিবালয়ে এই গোলটেবিল আলোচনায় ‘রিরাইটিং দ্য রুল বুক অফ রিজিওনাল কানেকটিভিটি’ শীর্ষক বক্তব‌্যে নিজের এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন ‘এশিয়া-প্যাসিফিক ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে’ ধারণা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে আসা আবু সাঈদ খান।

ইন্টারনেট যোগাযোগের অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে খরচ কমাতে এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের রুট ধরে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করার পরামর্শ দেন তিনি।

লার্নেশিয়ার জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো আবু সাঈদ খান

আবু সাঈদ খান বলেন, উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে ইন্টারনেট যোগাযোগ এখন ‘তুঙ্গে’; আর ইউরোপের অবস্থাও ‘অনেক ভালো’।

সেখানে পাতাল ধরে অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “পৃথিবীর ৬০ শতাংশ মানুষের বাস যেখানে, সেই এশিয়ায় ক্রস বর্ডার কোনো যোগাযোগ নাই। পুরোপুরি সাবমেরিন কেবলের উপরের নির্ভরশীল, যেটা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। যদিও সাবমেরিন কেবলের প্রয়োজনীয়তা আমরা অস্বীকার করছি না।”

জিবুতি হয়ে অস্টেলিয়া পর্যন্ত ফাইবার অপটিক কেবল টানার উদাহরণ দিয়ে আবু সাঈদ খান বলেন, “দূরত্ব কোনো বিষয় না। আপনি ভাল মানের ফাইবার দিয়ে দূরত্ব ঘুঁচিয়ে দিতে পারবেন। তা ইতোমধ্যে সম্ভবও হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে জিবুতিকে কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করছে। এটাই বাস্তবতা।”

লার্নেশিয়ার এই ফেলো এশিয়ান হাইওয়ের মাধ্যমে এশিয়া-প্যাসিফিক ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ের কেবল বিস্তৃত করার প্রস্তাব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে সীমানা পার হয়ে সংযুক্ত হবে এশিয়া ও ইউরোপ। আর এটি হবে সবচেয়ে বড় অপটিক্যাল ফাইবার রুট।

“এশিয়ান হাইওয়ের প্রান্তে ফাইবার কেবল বসানোর মাধ্যমে ৩২টি দেশ সংযুক্ত হবে। প্রত্যেক দেশের জন্য এটা ব্যবহারের সমান সুযোগ থাকবে। খরচ বহনের ক্ষেত্রেও তাদের সমান অংশ থাকবে।”

বিমসটেক মহাসচিব সুমিত নাকানডালা

সাঈদ খান বলেন, ভারতের ইন্টারনেট গেটওয়ের ক্ষেত্রে কক্সবাজার হচ্ছে চেন্নাই ও মুম্বাইয়ের পরে তৃতীয় গেটওয়ে। কারণ ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে ইন্টারনেট পৌঁছানো দরকার।

তার ভাষায়, “ভাল প্রযুক্তি, খারাপ প্রযুক্তি বলতে কোনো কথা নেই। কারা প্রযুক্তিকে কত ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারছে সেটাই দেখার বিষয়।”

একবিংশ শতাব্দীতে এসে আঞ্চলিক যোগাযোগের ধারণা অনেক বদলে যাওয়ায় তার সঙ্গে সমন্বয় করেই বিমসটেক দেশ ও এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর কানেকটিভিটিতে পরিবর্তন করার ওপর জোর দেন আবু সাঈদ খান।

প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে রেল যোগাযোগে সময় বাঁচার পাশাপাশি কীভাবে জটিলতা কমেছে- সে কথা বলতে গিয়ে তিনি ট্রান্সপ্যাসিফিক রেলওয়ে ও চীনের সুপার ট্রেনের প্রসঙ্গ তোলেন।

তিনি বলেন, চীন থেকে মাদ্রিদ ও লন্ডনের পথে ট্রেন চলাচলের মাধ‌্যমে এশিয়ার অর্থনীতি ইউরোপের অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছে। আর চীন থেকে স্পেনের মাদ্রিদ পর্যন্ত ব্লক কার্গো ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ায় কাস্টমসের ঝামেলা কমেছে।

“শুধু চীন থেকে ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা নয়, এর সঙ্গে নতুন নতুন রুটও যুক্ত হচ্ছে। যদিও জলপথের তুলনায় রেলে খরচ বেশি, তারপরও এটা সময় কমিয়ে আনছে।”

ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি নিনাদ এস দেশপাণ্ডে (বাঁয়ে)

এশিয়া-ইউরোপের সড়ক, রেল ও নৌপথে পণ্যের আসা-যাওয়ার এই চিত্র তুলে ধরে আবু সাঈদ খান বলেন, “এটা বাণিজ্যিক বাস্তবতা। রাজনৈতিক দিক থেকে কী হচ্ছে সেটা কেউ মাথা ঘামায় না। কূটনৈতিক দিক থেকে কী হচ্ছে সেটাতেও না। বাণিজ্যিক আগ্রহ হচ্ছে সবচেয়ে বড় আগ্রহ।”

গোলটেবিল বৈঠকে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, স্নায়ুযুদ্ধের চরম সময়ে এশিয়ান হাইওয়ে তৈরি হয়েছিল। জাপান, চীন, তুরস্ক রাজনৈতিক মতভিন্নতা ভুলে মহাদেশজুড়ে এই মহাসড়ক তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ওই সড়কের ৯০ শতাংশের বেশি এখনো কার্যকর।

আলোচনা অনুষ্ঠানের সঞ্চালক বিমসটেক মহাসচিব সুমিত নাকানডালা বলেন, “কানেকটিভিটির বিষয়টিকে আমাদের খোলা মনে দেখতে হবে। আমরা ইতোমধ‌্যে পরষ্পরের সঙ্গে যুক্ত হলেও এই যোগাযোগে অনেক বাধা রয়ে গেছে। সে বাধা মোকাবেলার সময় এসেছে এখন।”

বিমসটেকের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নানা বিষয়ে গোলটেবিল আলোচনার ধারাবাহিকতায় ‘কানেকটিভিটি’ নিয়ে এ গোলটেবিলের আয়োজন করার কথা জানান তিনি।

বিভিন্ন দেশের কয়েকজন রাষ্ট্রদূত অংশ নেন বিমসটেক আয়োজিত এ আলোচনায়

ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি নিনাদ এস দেশপাণ্ডে বলেন, কলকাতা থেকে আগরতলা এবং সেখান থেকে মিজোরামের রেললাইন মিয়ানমারের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার কাজ চলছে। এতে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে।

“একসময় ভারতের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছয়টি রেল সংযোগ ছিল, যা ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার এটা নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে তিনটি এখন কার্যকর, চতুর্থটি প্রায় কার্যকর এবং বাকি দুটি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটি রেল সংযোগ এতে যুক্ত হবে।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সহযোগিতায় এ গোলটেবিল বৈঠকে কানাডার হাই কমিশনার বেনোইট-পিয়েরে লারামি, থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত পানপিমন সোয়ান্নাপং, শ্রীলঙ্কার হাই কমিশনার ইয়াসোজা গুণাসেকারা, ভুটানের রাষ্ট্রদূত সোনাম টি রাবগাই এবং নেপালের শার্জ দ‌্য অ্যাফেয়ার্স ধন বাহাদুর ওলি উপস্থিত ছিলেন।

অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী ফারুক সোবহান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।