রিভিউ খারিজ, বিজিএমইএ ভবন ভাঙা এখন কেবল সময়ের ব্যাপার

ঢাকার হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় বেআইনিভাবে গড়ে তোলা বিজিএমইএ-এর ১৬ তলা ভবন ভেঙে ফেলতে সর্বোচ্চ আদালতের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করেছে আপিল বিভাগ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 March 2017, 05:05 AM
Updated : 16 April 2019, 04:40 AM

চূড়ান্ত আইনি লড়াইয়ে হার হওয়ায় দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের শিল্পোদ্যোক্তাদের সমিতি বিজিএমইএ-এর সামনে ভবনটি ভেঙে ফেলা ছাড়া আর কোনো পথ থাকল না।

কার্যালয় সরিয়ে নিয়ে ভবনটি ভাঙতে কতদিন সময় লাগবে তা জানিয়ে বিজিএমইএকে একটি আবেদন করতে বলেছে সর্বোচ্চ আদালত। বৃহস্পতিবার শুনানি করে আপিল বিভাগ এ বিষয়ে আদেশ দেবে। তখনই জানা যাবে, কতদিনের মধ‌্যে ভাঙতে হবে ওই ভবন।

প্রায় দুই দশক আগে নির্মিত বিজিএমইএ ভবনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত হাতিরঝিল প্রকল্পে ‘একটি ক্যান্সার’ বলেছিল হাই কোর্ট। ভবনটি অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেওয়া সেই রায়ের বিরুদ্ধে বিজিএমইএর লিভ টু আপিল গতবছর ২ জুন আপিল বিভাগে খারিজ হয়ে যায়।

আপিল বিভাগের ওই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য বিজিএমইএ যে আবেদন করেছিল, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বেঞ্চ রোববার শুনানি শেষে তাও খারিজ করে দেয়।

রায়ে বলা হয়, সরকারের কাছ থেকে বিজিএমইএ কীভাবে জমি পেয়েছে- তা আদালতের দেখার বিষয় নয়। ওই ভবন হয়েছে জালাধার আইন লঙ্ঘন করে।

রিভিউ শুনানিতে বিজিএমইএর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন কামরুল হক সিদ্দিকী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ‌্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

‘কত সময় লাগবে’

আপিল বিভাগের রায়ে বিজিএমইএকে ‘অবিলম্বে নিজেদের খরচে’ ওই ভবন ভেঙে ফেলতে বলা হয়েছিল। তারা তা না করলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে এবং ভবন ভাঙার টাকা বিজিএমইএর কাছ থেকে আদায় করবে বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল ওই রায়ে।

রোববার রিভিউ আবেদন খারিজ করে আদালত বিজিএমইএ-এর আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকীর কাছে জানতে চায়, ভবন ভাঙার নির্দেশনা বাস্তবায়নে কত সময় লাগবে।

কামরুল হক সিদ্দিকী বলেন, ভবনটির সঙ্গে দেশের পোকাশ রপ্তানি খাত জড়িত। সেখানে বিদেশি ক্রেতারা আসা-যাওয়া করেন। একটি উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে সেখানে স্থানান্তর করা সময়ের ব্যাপার।

আদালত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকেও একই প্রশ্ন করে। জবাবে তিনি বলেন, কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে।

এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, “হাই কোর্টের রায় হয়েছে অনেক দিন হয়ে গেল। ২০১১ সালের রায়। গুলশান, বনানী, বারিধারায় বিভিন্ন দূতাবাস চলছে বাড়িভাড়া করে। তাহলে এটি চালাতে পারবে না?”

রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটি দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা’। বিজিএমইএ-এর পক্ষ থেকে ভবনটি ভাঙার ব্যাপারে মৌখিকভাবে তিন বছর সময়ের আবেদন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপক্ষও এক বছর সময়ের কথা বলেছিল।

“আদালত বিজিএমইএ-কে বলেছে বৃহস্পতিবারের মধ্যে লিখিতভাবে আবেদন করতে। ওই দিনই আদালত বিজিএমইএ-কে ভবনটি ভাঙতে কতদিন সময় দেবে, সে বিষয়ে আদেশ দেবে।”

বিজিএমইএর আরেক আইনজীবী ইমতিয়াজ মইনুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা লিখিত আবেদন করব এবং তিন বছর সময় চাইব।”

মামলার পূর্বাপর

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৮ সালে বিজিএমইএ তাদের প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য সোনারগাঁও হোটেলের পাশে বেগুনবাড়ী খালপাড়ের এ জায়গাটি নির্ধারণ করে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছ থেকে ৫ কোটি ১৭ লাখ টাকায় জমিটি কেনে।

তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বছর বিজিএমইএ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২৮ নভেম্বর শুরু হয় ভবন তৈরির কাজ। ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিজিএমইএর ভবন উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।

বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের অভিযোগ ছিল, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে এবং উন্মুক্ত স্থান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ ভঙ্গ করে বেগুনবাড়ি খালের একাংশ ভরাট করার মাধ‌্যমে ওই ভবন তোলা হয়েছে। ভবনটি নির্মাণের সময় অনুমোদিত নকশাও অনুসরণ করা হয়নি বলে জানিয়েছিল রাজউক।

এ বিষয়ে একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদন নজরে আনা হলে ২০১০ সালের ৩ অক্টোবর হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল দেয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিজিএমইএ ভবন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাই কোর্ট।

রায়ে বলা হয়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অধিগ্রহণ করা ওই জমি ১৯৯৮ সালে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো যেভাবে বিজিএমইএকে দিয়েছে, তা ছিল বেআইনি। বিজিএমইএ যাদের কাছে ওই ভবনের ফ্ল্যাট বা অংশ বিক্রি করেছে, দাবি পাওয়ার এক বছরের মধ্যে তাদের টাকা ফেরত দিতে নির্দেশ দেওয়া হয় তৈরি পোশাক ব‌্যবসায়ীদের এ সংগঠনকে।

২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাই কোর্ট বলে, “একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে বিজিএমইএর আইনের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। তারা তা না করে আইনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে।”

ওই বছর মে মাসে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ হাই কোর্টে লিভ টু আপিল করে। ২০১৬ সালের ২ জুন আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দিলে হাই কোর্টের রায়ই বহাল থাকে।