গরুর হাটে অতিরিক্ত খাজনা আদায় ও চাঁদাবাজি বন্ধ করাসহ চার দফা দাবিতে ঢাকা মহানগর মাংস ব্যবসায়ী সমিতির ডাকে সোমবার থেকে ছয় দিনের এই ধর্মঘট শুরু হয়েছে।
সোমবার সকাল রাজধানীর কাপ্তানবাজার, গাবতলী, মিরপুর, পল্লবীসহ কয়েকটি এলাকায় ঘুরে মাংসের দোকানগুলো বন্ধ পাওয়া যায়। বাজারের দোকানে মাংস না মেলায় ক্রেতাদের ভিড় দেখা যায় রাজধানীর বিভিন্ন সুপারশপে।
গরু ও খাসির মাংসের বড় বাজার কাপ্তান বাজারে এসে সকালে দোকান বন্ধ দেখে ফিরে যাচ্ছিলেন যাত্রাবাড়ীর ব্যবসায়ী আবুল কালাম। বললেন, ধর্মঘটের বিষয়টি তার জানা ছিল না।
“এই দিক দিয়ে বাসায় যাচ্ছিলাম। ভাবলাম খাসির মাথা আর কলিজা কিনব। কিন্তু এখানে দেখি দোকান সব বন্ধ।”
কাপ্তানবাজারেই কথা হয় নারিন্দার বাসিন্দা আরিফুলের সঙ্গে। বাসায় মেহমান আসায় মাংস কিনতে কাপ্তানবাজার এসেছিলেন তিনি।
“মাংস তো নাই। সব দোকান বন্ধ। এখন মুরগী কিনতে হবে। দেখি অন্য কোথাও পাই কিনা। সুপারশপে একবার ঢু মারব।”
মাংসের দোকান বন্ধ থাকার প্রভাব পড়েছে রেস্তোরাঁতেও। খাসির মাংস না পাওয়ায় কাচ্চি বিরিয়ানি করা যায়নি বলে জানিয়েছেন গুলিস্তানের রাজধানী হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক রজব আলী।
"আমরা গরুর মাংস বেচি না। দোকান সব বন্ধ, খাসি পাই নাই। তাই আজকে বিরিয়ানি, মাংসের আইটেম বন্ধ। এই কয়দিন মুরগির বিরিয়ানি হবে।"
“মোকাম থেইকা গরু আনতেই দাম বেশি পইড়া যায়। বর্ডার থাইকা আইতে আইতে গরুর দাম বিশ হাজার ট্যাকা বাইড়া যায়। হের লাইগা গরু কাইটা আমাগো পোষায় না। সাড়ে চাইরশ ট্যাকা কেজি বেচলেও লোকসান হয়।”
কাপ্তানবাজারের আরেক ব্যবসায়ী জুলকালাম বলেন, খাজনার পাশাপাশি চাঁদাবাজদের দৌরাত্মের কারণেও দাম বেশি পড়ে। অন্যদিকে গরু ও খাসির চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় লাভ হয় না।
“খাসির চামড়া আগে আছিল ২৫০-৩০০ টাকা। সেই চামড়া এখন ২০-২৫ টাকার বেশি বেচা যায় না। এক কেজি লবণের দামও এরচে বেশি। চামড়া বেইচা আমরা কোনো টাকা পাই না। আবার রাস্তায় নানারকম চাঁদাবাজি, কস্ট পড়ে বেশি। কোনোভাবেই আমাদের পয়সা আসতেছে না। গরু হউক বা খাসি হউক, ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়।”
মাংসের দোকানগুলো বন্ধ থাকায় রাজধানীর সুপারশপগুলোতে ক্রেতাদের চাপ বেড়েছে। দৈনন্দিন পণ্যের সুপারশপ স্বপ্নের বিজয়নগর ও ওয়ারি শাখায় গিয়ে দেখা যায়, গরু ও খাসির মাংস শেষ হয়ে গেছে দুপুরের আগেই।
বিজয়নগর আউটলেটের অপারেশন ম্যানেজার ইব্রাহিম জানান, সকাল ১০টার মধ্যেই তাদের গরুর মাংসের স্টক শেষ হয়ে গেছে।
ধর্মঘটের কারণে স্বপ্ন মাংস বিক্রি বন্ধ রাখবে কি-না জানতে চাইলে ইব্রাহিম প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। স্বপ্নের গ্রাহক সেবা নম্বরে ফোন দিলে সেখান থেকে জানানো হয়, মাংস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং তাদের মাংস বিক্রিতে কোনো প্রভাব পড়বে না।
সুপারশপ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সমন্বয়ক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “মাংস ব্যবসায়ীদের ধর্মঘট নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। এ বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত জানাব।”
মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মূল অভিযোগ গাবতলী হাটের ইজারাদারদের বিরুদ্ধে। রোববার মানববন্ধনে মাংস ব্যবসায়ীরা বলেছিলেন, সরকারের আদেশ ‘অমান্য করে’ ইজারাদাররা অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের পাশাপাশি নিজেদের বাহিনী দিয়ে মাংস ব্যবসায়ীদের ওপর নির্যাতন করে।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গাবতলী হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন। হাটের ক্রেতাদের কাছ থেকে সিটি করপোরেশনের নির্ধারণ করা হারেই খাজনা আদায় করা হয় বলে দাবি করেন তিনি।
“আমাদের যদি সিটি করপোরেশনের দেওয়া ট্রেড লাইসেন্স দেখায়, তাহলে গরু প্রতি আমরা ৫০ টাকা ও মহিষের জন্য ৭০ টাকা করে রাখি। কিন্তু মাংস ব্যবসায়ী সমিতি অবৈধভাবে নিজেরা কার্ড দিয়েছে। ট্রেড লাইসেন্স দেখাতে না পারলে আমরা সিটি করপোরেশন নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী পশুর দামের শতকরা সাড়ে ৩ শতাংশ হাসিল আদায় করি।”
সারোয়ার হোসেন বলছেন, মাংস ব্যবসায়ী সমিতি তাদের দেওয়া কার্ড দেখালেও কম খাজনা রাখার দাবি করে আসছে।
“তারা তো সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, তারা লাইসেন্স দিতে পারে না। সেই লাইসেন্স দেখালে আমরা কেন খাজনা কম রাখব?”
অন্যদিকে ঢাকা মহানগর মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রবিউল আলমের দাবি, গরু কিনতে হলে সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স দেখাতে হবে- এমন কথা ইজারা চুক্তির কোথাও লেখা নেই।
“ট্রেড লাইসেন্সের কথা তারা বানিয়ে বলছে। তাছাড়া সিটি করপোরেশন আমাদের কোনো লাইসেন্স দিতে পারছে না। সেখানে তারা আমাদের লাইসেন্স দেখানোর হুকুম দেয় কীভাবে?”
ধর্মঘট শুরুর পর সোমবার বিকাল পর্যন্ত সরকার বা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ করেনি বলে জানান রবিউল।
তিনি বলেন, “আমাদের যদি আশ্বস্ত করা হয় যে দাবি মেনে নেওয়া হবে, তাহলে আমরা ধর্মঘট তুলে নেব। তা না হলে আগামী শনিবার পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে। এরপর সারাদেশে ধর্মঘট ডাকব।”