প্রাণ ফিরে পাচ্ছে সিটিসেল

দেনা পরিশোধে ব‌্যর্থ হওয়ায় বন্ধ করে দেওয়া দেশের প্রথম মোবাইল ফোন অপারেটর সিটিসেলের তরঙ্গ অবিলম্বে খুলে দিতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2016, 06:38 AM
Updated : 3 Nov 2016, 10:50 AM

কার্যক্রমে ফিরতে সিটিসেলের করা এক আবেদনের নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেয়।

আগামী ১৯ নভেম্বরের মধ্যে সিটিসেল বকেয়ার ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ না করলে আবারও তরঙ্গ বন্ধ করে দিতে পারবে বিটিআরসি।

আদালতের এই আদেশের পর সিটিসেলের সংযোগ ফিরিয়ে দিতে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন বিটিআরসির আইনজীবী ব্যারিস্টার রেজা-ই-রাব্বী খন্দকার।

তিনি বলেন, “আদেশের অনুলিপির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। আদেশের পরই আমি বিটিআরসির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ফোনে বলে দিয়েছি। বিটিআরসির যা সামর্থ‌্য আছে, তা নিয়ে সংযোগ ফিরিয়ে দিতে তারা কাজ শুরু করেছেন।”

সিটিসেলের কার্যক্রম বৃহস্পতিবারই চালু হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটাতো টেকনিক‌্যাল বিষয়। চালু করার জন্য যা যা করণীয় সেটা করা শুরু হয়েছে।”

আদালতে সিটিসেলের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ; সঙ্গে ছিলেন এএম আমিন উদ্দিন, ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান খান।

বিটিআরসির পক্ষে ছিলেন মাহবুবে আলম ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। তাদেরকে সহযোগিতা করেন মুরাদ রেজা, ব্যারিস্টার রেজা-ই-রাব্বী খন্দকার।

বকেয়া টাকা দুই দফায় পরিশোধের শর্তে সুপ্রিম কোর্ট এর আগে দুই মাস সময় দিলেও প্রথম কিস্তির পুরো অর্থ শোধ করতে ব‌্যর্থ হয় সিটিসেল। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০ অক্টোবর সিটিসেলের তরঙ্গ স্থগিত করা হয়। ওইদিন সন্ধ‌্যায় বিটিআরসির কর্মকর্তারা র‌্যাব-পুলিশ নিয়ে মহাখালীতে সিটিসেলের প্রধান কার্যালয়ে ঢুকে তরঙ্গ বন্ধের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন।

১৯৮৯ সালে বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল ফোন অপারেটর হিসেবে লাইসেন্স পায় বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (বিটিএল), যা পরে মালিকানার হাতবদলে সিটিসেলে পরিণত হয়।

সর্বশেষ তথ‌্য অনুযায়ী, এ কোম্পানির ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক বিএনপি নেতা মোরশেদ খানের প্যাসিফিক মোটরস লিমিটেড।

এছাড়া সিঙ্গাপুরের সিংটেল এশিয়া প্যাসিফিক ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এর ৪৫ শতাংশ এবং ফার ইস্ট টেলিকম লিমিটেড ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক।

ঘটনাক্রম

# পৌনে পাঁচশ কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধের জন‌্য কয়েক দফা তাগাদা দিয়েও তা না পেয়ে গত জুলাই মাসে সিটিসেলের কার্যক্রম বন্ধ করার উদ‌্যোগের কথা জানায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। পরের মাসে সিটিসেলকে নোটিস দেওয়া হয়।

# ওই নোটিসের বিরুদ্ধে সিটিসেল হাই কোর্টে যায়। ২২ অগাস্ট হাই কোর্টের আদেশে বলা হয়, নোটিসের জবাব দিতে বিটিআরসি যে এক মাস সময় দিয়েছিল, ওই সময় পর্যন্ত সিটিসেলকে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

# হাই কোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় বিটিআরসি। ২৯ অগাস্ট আপিল বিভাগের আদেশে দেনা শোধের জন‌্য সিটিসেলকে দুই মাস সময় দেয় আপিল বিভাগ। বিটিআরসির পক্ষ থেকে বলা হয়, বকেয়া ৪৭৭ কোটি টাকার মধ‌্যে দুই তৃতীয়াংশ প্রথম এক মাসে এবং এক তৃতীয়াংশ পরবর্তী এক মাসে পরিশোধ করতে হবে।

এছাড়া ১৭ অগাস্টের পর থেকে প্রতিদিন বিটিআরসির কাছে পাওনা হওয়া ১৮ লাখ টাকা করে অবিলম্বে পরিশোধের নির্দেশ দিয়ে আদালত বলে, টাকা না পেলে বিটিআরসি যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে।

# ২০ অক্টোবর সিটিসেলের তরঙ্গ স্থগিত করে বিটিআরসি। মহাখালীতে সিটিসেলের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন বিটিআরসি কর্মকর্তারা।

টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সেদিন জানান, একমাসের প্রথম কিস্তিতে নির্ধারিত ৩১৮ কোটি ৪২ লাখ টাকার মধ‌্যে সিটিসেল মাত্র ১৩০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।

# এরপর সিটিসেল তরঙ্গ বাতিলের সিদ্ধান্ত স্থগিত বা পুনরায় তরঙ্গ বরাদ্দের নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে যায়। শুনানি শেষে আদালত ৩ নভেম্বর আদেশের দিন রাখে। বৃহস্পতিবার সিটিসেলের তরঙ্গ খুলে দিতে বলা হয়।   

ফাইল ছবি

বিরোধ নিষ্পত্তিতে কমিটি

বিটিআরসি ৪৭৭ কোটি টাকা পাওনা থাকার কথা বলে এলেও সিটিসেলের আইনজীবী ১ নভেম্বর আপিল বিভাগের শুনানিতে বলেন, তাদের হিসাবে এই অংক ২৩০ কোটি টাকা, যার দুই-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ ১৪৪ কোটি টাকা তারা প্রথম কিস্তিতে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিশোধ করেছে। তারপরও সিটিসেলের তরঙ্গ বন্ধ করা সরকারের ঠিক হয়নি বলে তিনি দাবি করেন।  

সিটিসেলের আইনজীবী অভিযোগ করেন, তার মক্কেল কোম্পানির ১০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বরাদ্দ পাওয়ার কথা থাকলেও কার্যত ঢাকায় ৬ মেগাহার্টজ এবং ঢাকার বাইরে ২ মেগাহার্টজের কিছু বেশি তরঙ্গ দেওয়া হয়েছে। যতক্ষণ পুরো তরঙ্গ সিটিসেল না পাচ্ছে, ততক্ষণ জরিমানা, সুদ দিতে তারা অপারগ।

এরপর বিটিআরসি বৃহস্পতিবার আদালতে তাদের দাবির পরিমাণ কমিয়ে ৩৯৭ কোটি টাকায় নিয়ে আসে। কিন্তু ওই অংক নিয়েও সিটিসেল আপত্তি তোলে।

এই প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় কিস্তিতে সিটিসেলকে কত টাকা দিতে হবে তা নির্ধারণ করে দেয় আদালত। বলা হয়, ১৯ নভেম্বরের মধ্যে সিটিসেল ১০০ কোটি টাকা না দিলে বিটিআরসি আবার তরঙ্গ বন্ধ করে দিতে পারবে।

পাশাপাশি টাকার অংক নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন‌্য আদালত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দিয়েছে।

এছাড়া পদমর্যাদায় বিটিআরসির কমিশনার (স্পেক্ট্রাম) এবং টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের নিচে নন- এমন একজন কর্মকর্তা এ কমিটিতে থাকবেন।

কমিটি বিরোধ নিষ্পত্তি করে এক মাসের মধ্যে যে সিদ্ধান্ত দেবে, তাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে বলে জানিয়েছে আদালত।

কমিটির চেয়ারম্যান সম্মানী হিসেবে ৫ লাখ টাকা এবং অপর দুই সদস্য আড়াই লাখ টাকা করে পাবেন। সিটিসেল ও বিটিআরসি এই অর্থ যোগাবে।

রেজা-ই-রাব্বী খন্দকার পরে সাংবাদিকদের বলেন, “যদি টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরের সঙ্গে অপারেটরের কোনো বিরোধ হয়, আইনে সেটা নিষ্পত্তির কোনো ব্যবস্থা নাই। আদালত মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে, যেন এ ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করে। এমন বিধান যেন তারা সংযোজন করে, যেখানে আপিল বা রিভিয়ের ব্যবস্থা থাকবে। মন্ত্রণালয়কে সেভাবেই অ‌্যাডভাইস করব বলে আমরা আদালতকে জানিয়েছি।”

বিটিআরসির আইনজীবী বলেন, সিটিসেলের প্রত্যেকদিন যে ফি বিটিআরসিকে দেওয়ার কথা, তা তাদেরকে দিতে হবে। তাতে ব্যর্থ হলে বিটিআরসি আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে পারবে বলে আপিল বিভাগ আদেশে জানিয়েছে।

বিটিআরসির দাবির অংক কমার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এই আইনজীবী বলেন, “বিটিআরসি এখন যেটা বলছে, তাদের দাবি করা অর্থে আর কোনো বিরোধের সুযোগ নেই। এটা হচ্ছে প্রি-ডিসাইডেড একটা ফিগার। অংকের হিসাব।

“আগে আমরা ১০ মেগাহার্টজের হিসাবে দাবি করেছিলাম, আজ সংশোধিতভাবে ৮ দশমিক ৮২ মেগাহার্টজের জন‌্য দাবির অংক বলেছি। এটা আমরা ইতোমধ্যে সিটিসেলকে দিচ্ছি। এইজন্য আমরা ৩৯৭ কোটি টাকার একটা সংশোধিত অংক বলেছি।”

এক প্রশ্নের জবাবে রেজা-ই-রাব্বী বলেন, সিটিসেলকে ১০ মেগাহার্টজ স্পেক্ট্রাম দেওয়ার কথা থাকলেও বরাদ্দ দেওয়ার মত স্পেক্ট্রাম বিটিআরসির হাতে নেই। যখন থাকবে তখন দেওয়া হবে।

সিটিসেলের আইনজীবী মোস্তফিজুর রহমান খান বলেন, “বিটিআরসি আগের দাবি থেকে ৩৯৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এটা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট- কারণ দর্শানোর দাবিতে টাকার পরিমাণ ভুল ছিল। এটা আদালতও রেকর্ড করেছে।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের হিসাবে তারা ২১৬ কোটি টাকা পায়। এ পর্যন্ত দিয়েছি ১৪৪ কোটি টাকা। এখন আবার ১০০ কোটি টাকা দিলে আমাদের স্বীকৃত দায়ের চেয়ে বেশি টাকা চলে যাবে। আমরা সেটা দিচ্ছি। কিন্তু যদি নিষ্পত্তির পর আমরা থাকি- সেটা পরে সমন্বয় করা হবে।”

এই আইনজীবী জানান, সিটিসেলের দেওয়া ১৪৪ কোটির মধ‌্যে কর বাবদ ১৪ কোটি টাকা গেছে রাজস্ব খাতে। আর ১৩০ কোটি টাকা বিটিআরসির পকেটে গেছে।