চাকরি নিয়ে শঙ্কায় গুলশানের হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মীরা

হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর আবাসিক ভবনে গড়ে তোলা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে গুলশানের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর কর্মীদের মধ্যে। এরই মধ্যে অনেকে পেয়েছেন চাকরিচ্যুতির নোটিস, বাকিরা আছেন আশঙ্কায়।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 August 2016, 03:12 AM
Updated : 18 August 2016, 04:32 AM

গত ১ জুলাইয়ের জঙ্গি হামলার পর ব্যবসা বাণিজ্যে ধসের মধ‌্যে শুরু হওয়া এই উচ্ছেদ অভিযানের কারণে স্বস্তিতে নেই মালিকরাও।

রাজধানীজুড়ে উচ্ছেদ অভিযানে এরই মধ্যে গুলশানের ১২টি রেস্তোরাঁ ও একটি হোটেল, উত্তরায় ১৭টি রেস্তোরাঁ ও পাঁচটি হোটেল, ধানমন্ডিতে নয়টি রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিয়েছে রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

এ উচ্ছেদ অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে সব মিলিয়ে ১ লাখ লোক কর্মহীন হতে পারে বলে আশঙ্কা হোটেল ও রেস্তোরাঁ মালিকদের।  

এজন‌্য হোটেল, গেস্ট হাউজ ও রেস্তোরাঁ উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত রাখার দাবি জানিয়েছেন তারা, যাতে এফসিসিআইও  সমর্থন দিয়েছে।

তবে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্থির।

“আবাসিক এলাকায় এসব বাণিজ্যিক ভবন রাখা যাবে না, কোনোভাবেই না। আমরা এদের আর অ্যালাউ করব না।”

হোটেল-গেস্টহাউজ অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ‌্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এইচজিআরওএবি)-র তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমণ্ডি ও উত্তরায় সব মিলিয়ে ৬০টি হোটেল ও গেস্ট হাউজ এবং ৫০০টি রেস্তোরাঁ রয়েছে।

এসব হোটেল-রেস্তোরাঁয় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে বলেও দাবি তাদের।

হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার তিন সপ্তাহ পর ২০ জুলাই আবাসিক এলাকায় থাকা ২ হাজার ৪০০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে নোটিস দেয় রাজউক, এরপরই শুরু হয় উচ্ছেদ অভিযান।

গত ২৭ জুলাই গুলশানের হলিডে ভিলাগ্রাম হোটেলে অভিযান চালায় রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার সঙ্গে হোটেলে থাকা বিদেশি অতিথিদের বের করে দেওয়ারও নির্দেশ দেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক।

এরপর থেকেই চাকরি হারানোর ভয়ে আছেন হোটেলটির ৪৪ জন কর্মী।

“জীবনের অর্ধেক সময় পেরিয়ে এখন অন্য কোনো পেশায় যাওয়ার জায়গা নেই। এখন উঠিয়ে দিলে আমরা যাব কোথায়?” বলেন হোটেলের ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ব্যবস্থাপক নাজিম সরদার।

উচ্ছেদের আগে ‘বিকল্প নির্ধারণে’ সময় চান তিনি।

“আমরাও সরকারের এ উদ্যোগকে সমর্থন করি। কিন্তু বিকল্প তৈরি না করে এভাবে উচ্ছেদ করলে তো বিপদে পড়ে যাব।”

৮ নম্বর সড়কে থাকা এ হোটেলের মহাব্যবস্থাপক আশিকুর রহমান জানান, গুলশানে হামলা হওয়ার পর থেকে গ্রাহকখরায় আছেন তারা।

“১২ জুলাই পর্যন্ত  কোনো রিজার্ভেশন পাইনি। এরপর আস্তে আস্তে অতিথিরা আসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু এ উচ্ছেদ অভিযানের কারণে তাদের আতঙ্ক আরও বেড়ে গেছে।”

হলি আর্টিজানে হামলায় ১৭ বিদেশি নিহত হওয়ার পর বিভিন্ন দেশের দূতাবাস তার দেশের নাগরিকদের চলাচলে সতর্কতা জারি করে। ফলে বিদেশিদের যাতায়াত কমে যায় রেস্তোরাঁগুলোতে।

আবার ওই হামলার পর নিরাপত্তার কড়াকড়িতে দেশের মানুষও গুলশান এলাকা এড়িয়ে  চলতে চাইছেন। 

বাংলাদেশে বিদেশি মিশনগুলোর অধিকাংশই এই গুলশানে। এসব মিশনের কর্মকর্তারা কর্মস্থলের পাশে গুলশানে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ‌্য বোধ করেন। তারাই ছিল গুলশানের রেস্তোরাঁগুলোর প্রধান ভোক্তা।

হলিডে ভিলাগ্রামের মহাব‌্যবস্থাপক আশিক বলেন, “গুলশান হামলার পর বিদেশিরা এমনিতেই বেশ আতঙ্কিত। এরপর অভিযান চালিয়ে হোটেলে থেকে বের করে দিলে তারা তো এদেশে থাকতেই চাইবে না।”

চাকরি হারানোর আতঙ্কে আছেন ১১৩ নম্বর সড়কের ইস্তানবুল রেস্তোরাঁর কর্মীরাও।

নিজের চাকরি নিয়েও শঙ্কায় থাকা রেস্তোরাঁটির ব্যবস্থাপক মো. ইউনুস আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন চাকরির বাজার খুব খারাপ। গুলশানের ঘটনার আগে মালিকরা দক্ষ ম্যানেজার-ওয়েটার খুঁজত। কিন্তু এখন কর্মীরা দ্বারে দ্বারে ঘুরছে, কাজ নাই। উচ্ছেদ করে দিলে অবস্থা আরও খারাপ হবে।”

২৮ জুলাই রাজউক কর্তৃপক্ষ রেস্তোরাঁটি বন্ধ করে দেয়। ১০দিন পর আবার চালু হলেও কাঙ্ক্ষিত গ্রাহক না পাওয়ায় মালিকপক্ষ দ্রুতই চাকরি ছাড়ার নোটিস দিতে পারে বলে শঙ্কা ইউনুসের।

রাজউকের এ উচ্ছেদ অভিযান হোটেল-রেস্তোরাঁর ‘মন্দা বাজার’কে আরও সঙ্কটে ফেলবে বলে মত গুলশানের মেরাকি রেস্তোরাঁর মালিক শাহ আলমের। উচ্ছেদ অভিযানের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

“এসব প্রতিষ্ঠান তো একদিনে গড়ে উঠেনি। রাজউকের লোকজনের চোখের সামনেই গড়ে উঠেছে। তখন তারা কেন বলল না যে এখানে এসব স্থাপনা গড়ে তোলা যাবে না। কেউ তো এসে বলেনি, এসব স্থাপনা করছো কেন?”

এ উচ্ছেদ অভিযানের কারণে পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে ট্যুর অপারেটররাও। তাদের ভাষ্য, মাঝারি মানের হোটেলেগুলো বন্ধ হলে বিদেশি অতিথিদের থাকার জায়গার সঙ্কট হবে।

এবি ট্যুরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুরশিদ আলী মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক পর্যটকই ঢাকায় দু-একদিন অবস্থান করে বাইরে বেড়াতে চলে যান। এ ধরনের অতিথিরা স্বল্পমূল্যের হোটেলে থাকতে চায়, তাই মাঝারি মানের হোটেল বন্ধ হয়ে গেলে তাদের জন্য অসুবিধা হবে। তারা হয়ত আর আসতেই চাইবেন না।”

হোটেল রেস্তোরাঁ উচ্ছেদ না করে এগুলোর জন্য একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে হোটেল-গেস্টহাউজ অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ‌্যাসোসিয়েশন-এইচজিআরওএবি।

সংগঠনটির নির্বাহী কমিটির সদস্য খালেদুর রহমান সানি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের একটা নিয়ম করে দিক, আমরা সেভাবেই এসব হোটেলে-রেস্তোরাঁ পরিচালনা করব।

“যাদের পার্কিংয়ের জায়গা নেই তাদের পার্কিংয়ের জায়গা করতে বাধ্য করা হোক, নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে নির্দেশনা দেওয়া হোক।”

পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) হোটেল রেস্তোরাঁ খাতের অবদান ১ দশমিক ০৩ শতাংশ, আগের বছরেও যা ছিল ১ দশমিক ০২ শতাংশ।

“এই সেক্টরটাকে ধ্বংস করে দিয়েন না, এগুলো তুলে দিলে আমরা যাব কোথায়?” অনুরোধ সানির।