এটিএম আমদানিতে তেলেসমাতি!

বাংলাদেশে বৈধ পথে যতো অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম) আমদানি হয়েছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বুথ রয়েছে ব্যাংকগুলোর। ওই সংখ্যা মেলাতে গিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে এটিএম আমদানির তথ্য বেরিয়ে এসেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের তদন্তে।

মিন্টু চৌধুরীআবদুর রহিম হারমাছি, ও সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Feb 2016, 12:18 PM
Updated : 25 Feb 2016, 06:32 PM

কর্মকর্তারা বলছেন, কম্পিউটার যন্ত্রাংশের কথা বলে খোলা অবস্থায় আনা হচ্ছে এটিএম। আবার ‘স্যাম্পলের’ নাম করে আনা হচ্ছে কুরিয়ারে। দুইভাবেই বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে আমদানিকারকরা। 

চীনের তৈরি একটি এটিএম আমদানি করতে মোটামুটি আট লাখ টাকা খরচ করতে হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত এনসিআর করপোরেশনের এটিএম কিনতে লাগে মোটামুটি ১০ লাখ। অথচ মাত্র ছয় লাখ টাকাতেই এটিএম মিলছে বাংলাদেশে।

অবিশ্বাস্য কম দামে এই এটিএম সরবরাহ করছে ইনফরমেশন টেকনোলজি কনসালটেন্টস লিমিটেড ও টেকনোমিডিয়া লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। চীন, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে এটিএম আমদানি করে ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করে তারা।

এই তদন্তের সূত্র ধরে কোন ব্যাংক কোন সময়ে কতোটি এটিএম আমদানি করেছে তার বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে (এমডি) এ বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

“যদি দেখা যায়, কোনো ব্যাংক যে পরিমাণ এটিএম আমদানি করেছে তার চেয়ে বেশি মেশিন বসিয়েছে, তাহলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। কোনো ব্যাংক অবৈধ বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে এটিএম আমদানি করে থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” বলেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মঈনুল খান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এটিএম মেশিন আমদানির নামে মুদ্রা পাচার হচ্ছে কি না- সে বিষয়টিও তারা খতিয়ে দেখছেন।

আমদানিকারক প্রধান দুটি প্রতিষ্ঠান কোনো ধরনের অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, কাস্টমস কর্মকর্তাদের উচিৎ তাদের নথি আবার মিলিয়ে দেখা।

আর ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) বলেছে, কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

ধাঁধা মেলাতে তথ্য

বাংলাদেশে প্রথম এটিএম এনেছিল স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। ১৯৯৪ সালে ঢাকার কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ে চালু হয়েছিল তাদের সেই বুথ। এরপর মতিঝিল, ধানমন্ডিসহ ঢাকায় অন্যান্য স্থানেও এ ব্যাংকের বুথ বসে। বর্তমানে তাদের মোট বুথ সংখ্যা ৮৩টি।

এক দশক পর এটিএম সেবা শুরু করলেও ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বুথ সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের বুথ সংখ্যাও দুশ’র বেশি।

সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের ৫৩টি ব্যাংক সাত হাজারের বেশি এটিএম বুথ থেকে প্রায় এক কোটি গ্রাহককে কার্ডের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে।

মঈনুল খান বলেন, “তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, যে পরিমাণ এটিএম আছে, বৈধ পথে তার চেয়ে অনেক কম আমদানি হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- বাকি মেশিন কীভাবে আনা হয়েছে?”

আমদানির তথ্য পর্যালোচনা করে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দেখেছেন, ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে চট্টগ্রাম কাস্টমসের মাধ্যমে ৬০৪টি অটোমেটেড টেলার মেশিন আমদানি হয়েছে।

এর মধ্যে ৬০৩টিই আমদানি করেছে ইনফরমেশন টেকনোলজি কনসালটেন্টস লিমিটেড। মাত্র একটি মেশিন এনেছে ভরটেক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ওই সময়ে টেকনোমিডিয়া লিমিটেডের নামে এটিএম আমদানির কোনো তথ্য চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে নেই।

২০১৩ সালের অক্টোবরের আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে তথ্য নথিভুক্ত করা হতো কেবল খাতায় লিখে। ফলে তার আগে কতো এটিএম আমদানি হয়েছে সে তথ্য উদ্ধার করা কঠিন।

ব্যাংকগুলোতে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, যেসব সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরাসরি অথবা দরপত্র কিংবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে এটিএম মেশিন কেনা হয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য পাঠাতে হবে।

চলতি ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যেসব প্রতিষ্ঠান এটিএম মেশিন এনেছে, তাদের ভ্যাট নিবন্ধন নাম্বার, এটিএম মেশিন সংখ্যা, মেশিনের ব্র্যান্ড ও মডেল, আমদানির সময় কী পরিমাণ উৎসে কর দেওয়া হয়েছে- এসব তথ্যও অধিদপ্তর চেয়েছে।

“এসব তথ্য পাওয়ার পর আমরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখব। প্রকৃত দাম এবং ঘোষিত মূল্য কত, তাও খতিয়ে দেখা হবে,” বলেন মঈনুল খান।

সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথে জালিয়াতির ঘটনায় গ্রাহকদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ায় মেশিনের মান নিয়েও খোঁজ খবর করা হচ্ছে বলে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান।

শুল্ক ফাঁকি

কর্মকর্তারা জানান, জাহাজে করে যেসব এটিএম আনা হয়েছে, সেগুলোর তথ্য চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে থাকার কথা। জাহাজে করে এটিএম আনার পরও যদি কাস্টমস হাউসের খাতায় তা না আসে, তাহলে বুঝতে হবে মিথ্যা ঘোষণায় এটিএম আমদানি করে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে।

এটিএম আমদানি করা হয় যন্ত্রাংশগুলো খোলা অবস্থায়, যেগুলো আবার কম্পিউটার যন্ত্রাংশের মতো দেখতে। দেশে আনার পর সেগুলো জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয় এটিএম বুথ।

আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক লাগে না। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়েই কম্পিউটারের নামে এটিএম আনার তথ্য পেয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দারা। 

কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, এটিএম আমদানিতে (৮৪৭২৯০১০’র এইচএস কোডে) মোট শুল্ক কর দিতে হয় ৩১ শতাংশের মতো। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ ডিউটি, ৫ শতাংশ এআইটি (অগ্রিম আয়কর) ও ৪ শতাংশ এটিভি (অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাট)।

ব্যাংক সরাসরি আমদানি করলে ওই ৪ শতাংশ এটিভি বাদ যায়। তবে নানা ঝামেলার কারণে কোনো ব্যাংকই গত আড়াই বছরে নিজেরা সরাসরি এটিএম আমদানি করেনি।

অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, উড়োজাহাজে করেও দেশে আনা হচ্ছে এটিএম। আবার কুরিয়ার সার্ভিসে এলসি ছাড়াই নমুনা বা স্যাম্পল আনার সুযোগও এটিএম আনতে কাজে লাগানো হচ্ছে।

চট্টগ্রাম শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জাকির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের তদন্ত কাজ এগিয়ে চলছে। অতীতে কী পরিমাণ এটিএম আমদানি হয়েছে তার তথ্য সংগ্রহ করছি আমরা।”

কী বলছে ব্যাংক?

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের চিঠির বিষয়ে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান আনিস এ খানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি অসুস্থতার কথা বলেন।

“এখন এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে পারছি না। তবে কেউ যদি মিথ্যা তথ্য দিয়ে বা অন্য কোনো অবৈধ উপায়ে এটিএম এনে থাকে তাহলে অবশ্যই তাদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।”

ব্যাংক কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।  

অবশ্য ডাচ-বাংলা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, তার ব্যাংক টেকনোমিডিয়া লিমিটেডের মাধ্যমেই এটিএম আমদানি করে থাকে।

“আমাদের সব মেশিনই যুক্তরাষ্ট্রের এনসিআর ব্রান্ডের। এখন পর্যন্ত এগুলোই সবচেয়ে উন্নত মানের।”

২০০৪ সাল থেকে দেশে এটিএম সেবা চালু করা ডাচ বাংলা ব্যাংক ২০১০ সালের পর এ কার্যক্রমের ব্যাপক সম্প্রসারণ শুরু করে। ২০১১ সালে এক হাজার এবং ২০১৫ সালে দুই হাজার এটিএম বুথ বসানো হয় বলে ওই কর্মকর্তা জানান।

‘গ্যারান্টি দিচ্ছি, সব বৈধ’

বর্তমানে যে দুটি প্রতিষ্ঠান এটিএম আমদানি করে ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করছে, তারা কেউই শুল্ক ফাঁকি বা অনিয়মের দায় নিতে রাজি নয়।

টেকনোমিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (বিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) জাকির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা এটিএম মেশিন সরবরাহ, ইনস্টল ও মেইনটেইনেন্সের সেবা দিয়ে থাকেন।

“এখন আমাদের ব্যবস্থাপনায় আড়াই হাজারের মতো মেশিন রয়েছে। এর মধ্যে ১৫০টির মতো এটিএম আমরা আমদানি করিনি। বাকিগুলো আমরাই আমদানি করে বিভিন্ন ব্যাংককে সরবরাহ করেছি।”

বাংলাদেশের অধিকাংশ এটিএম বৈধভাবে আমদানি করা হয়নি- এমন অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাকির দাবি করেন, তাদের আনা সব মেশিনই বৈধভাবে আমদানি করা হয়েছে।

“চার-পাঁচ বছর আগে টেকনোমিডিয়া এই ব্যবসা শুরু করেছে। অন্যদেরটা আমরা জানি না। আমাদেরগুলো বৈধভাবেই আমদানি করা হয়েছে।”

টেকনোমিডিয়ার আনা এটিএম মেশিনের দাম জানতে চাইলে ব্যবস্থাপক বলেন, “কেইস টু কেইস এটা ডিফার করে। এভাবে সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।”

একই সুরে কথা বলেছেন ইনফরমেশন টেকনোলজি কনসালটেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সাইফুদ্দিন মুনির।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কাস্টমসের হিসাবটা আমি দেখেছি। আমার মনে হয়, উনাদের বিষয়টা আবার চেক করা দরকার। উনারা যে হিসাব বলছেন, এটা কোথা থেকে পেয়েছেন, আমি জানি না। আমার জানা মতে, একদম গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, অন্তত দুই হাজার এটিএমের হিসাবে আছে। এটা কাস্টমসে প্রুভ করা যাবে।”

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা চালু হওয়ার আগের হিসাবও খুঁজে দেখা উচিৎ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“বাংলাদেশে সত্যিকারভাবে এটিএম আমদানি শুরু হয়েছে ২০১০ সালের পর। এর আগে অল্প অল্প করে আনতো। ‘আমরা টেকনোলজি’ ও ‘লিডস’ তখন এটিএম আনতো।”

বিমানে করে এটিএম আমদানির যে কথা বলা হচ্ছে তা আদৌ লাভজনক হওয়া সম্ভব কি না তাও বিবেচনা করে দেখতে বলেন মুনীর।

এটিএম হিসাবে ঘোষণা না দিয়ে অন্য কোনভাবে আনা যায় কি-না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “সেটা আমি বলতে পারব না, সেটা যারা তদন্ত করেছে, তারাই বের করুক এবং বের করাটা উচিৎ।”

ইনফরমেশন টেকনোলজি কনসালটেন্টস ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২ হাজার এটিএম আমদানি করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা প্রত্যেকটাই এটিএম হিসাবে এলসি করে এনেছি। এর ডকুমেন্ট আমাদের কাছে যেমন আছে, ব্যাংকের কাছে আছে, কাস্টমসের কাছেও আছে।”

মুনির জানান, তার কোম্পানি প্রায় ৩ হাজার এটিএম মেশিনের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে।