৬ বছরেও চিহ্নিত হয়নি হেরিটেজ ভবন এলাকা

২০০৯ সালের সরকারি গেজেটে হেরিটেজ ভবন সংরক্ষণের কথা বলা হলেও গত ছয় বছরেও ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলোর এলাকাই চিহ্নিত করতে পারেনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।

আশিক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 July 2015, 04:24 AM
Updated : 4 July 2015, 05:54 AM

সম্প্রতি লালবাগ কেল্লার দেওয়াল ভেঙে স্থাপনা নির্মাণের প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস হচ্ছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করাকড়িভাবে সংরক্ষণ করা হলেও ঢাকায় ঐতিহ্যের সব ভবন ভেঙে নতুন স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে বহুদিন থেকেই।

এমনকি ২০০৯ সালে সরকারি গেজেটে যে ৯৩টি ভবন ও চারটি এলাকাকে হেরিটেজ হিসাবে সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছিল, সেগুলোও বাদ যাচ্ছে না ধ্বংসের হাত থেকে।

সম্প্রতি লালবাগ কেল্লার একটি দেয়াল ভেঙে গাড়ি রাখার স্থান তৈরির বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে হেরিটেজ সংরক্ষণের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।

এরপর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হেরিটেজ স্থাপনাগুলোর এলাকা চিহ্নিত করতে তালিকা তৈরির কাজ মাত্র শুরু করছেন তারা।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাধারণত ১০০ বছর বা তার বেশি পুরনো স্থাপনাকে হেরিটেজের তালিকায় রাখা হয়। ওই তালিকাভুক্ত স্থাপনা ভেঙে নতুন স্থাপনা গড়তে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়।

বাংলাদেশে হেরিটেজ তালিকায় থাকা এসব স্থাপনা ভাঙতে হলে রাজউকের বিশেষ অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো তদারকি তেমন দেখা যায় না।

হেরিটেজ নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসা আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তৈমুর ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটি হেরিটেজ সাইট প্রিজারভেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এর চারপাশে ২৫০ মিটার বাফার জোন তৈরি করা। এটি করতে হলে আগে সেই স্থাপত্যটির এলাকা চিহ্নিত করতে হবে।

“এতগুলো বছর পার হয়ে গেল, এখনও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ কাজটিই করতে পারেনি। আর এ সুযোগে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস হচ্ছে।”

ছোট কাটরা বা বড় কাটরার কথা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, “পুরান ঢাকায় এখন যদি কেউ যায়, কেউ বলতে পারবে কোথায় ছোট কাটরা কিংবা কোথায় বড় কাটরা। অথচ এ দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি স্থাপত্য।”

পুরান ঢাকার ছোট কাটরা

পুরান ঢাকার বড় কাটরা

 

২০১২ সালে পুরান ঢাকার জনসন রোডে অবস্থিত ঢাকা জেলা কাউন্সিল ভবনটি ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হলে হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেন আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তৈমুর।

তার পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ৮ অক্টোবর হাই কোর্ট বেঞ্চ তিন মাসের মধ্যে হেরিটেজ স্থাপনা এবং এলাকার পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের জন্য এলজিইডি, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) নির্দেশ দেয়।

বেঁধে দেওয়া সময় প্রায় আড়াই বছর আগে পার হয়ে গেলেও এখনও তৈরি করা হয়নি হেরিটেজ স্থাপত্যগুলোর পূর্ণাঙ্গ তালিকা।

তৈমুর বলেন, “যে ভবনগুলো সংরক্ষণের জন্য এ তালিকা প্রণয়ন করতে বলা হচ্ছে, সেগুলোই একটার পর একটা ভেঙে ফেলা হচ্ছে। গত এক বছরে যেভাবে এ ভবনগুলোর উপরে কনস্ট্রাকশন হচ্ছে তাতে এ তালিকা হওয়ার পর একটি ভবনও পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি না।”

তৈমুরের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ধরনের মনুমেন্ট বা দালানগুলো সংরক্ষণের জন্য একটি হেরিটেজ পলিসি প্রয়োজন যেটি বর্তমান পুরাকীর্তি আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করবে। এটি হবে আন্তর্জাতিক পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনের আদলে।”

“মনুমেন্ট সংরক্ষণের পাশাপাশি কিছু খাল বা ব্রিজ যেগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে, সেগুলোও সংরক্ষণ করা উচিত। শুধু আরবান সাইটগুলোই নয় রাজধানীর বাহিরেও বহু প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন রয়েছে সেগুলোকেও সংরক্ষণ করা উচিত।”

কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল

কলকাতা শহরের উদাহরণ দিয়ে এই গবেষক বলেন, “অনেক কলোনিয়াল ও লেট মুঘল মনুমেন্ট তারা সংরক্ষণ করতে পেরেছে। হেরিটেজ নিয়ে তাদের একটি নীতিমালা রয়েছে এবং এটি কঠোরভাবে মানা হয়।

“রোম বা এথেন্স শহরে কোনো কন্সট্রাকশন করতে হলে সেদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। আমরা এ উদাহরণগুলো থেকে শিখতে পারি।”

প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলতাফ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এলাকা চিহ্নিত করার কাজ চলছে।”

তবে এটি কবে নাগাদ শেষ হবে এ বিষয়টি নিশ্চিতভাবে বলতে পারেননি তিনি।

হেরিটেজ ভবন সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কী দায়িত্ব পালন করছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বেশ কিছু কাজ আমরা শুরু করেছি। সাইটগুলোর বাফার জোন ও কোর জোন নির্ধারণের কাজ চলছে। আমরা একটি হেরিটেজ নীতিমালা তৈরির কাজে হাত দিয়েছি।”

আলতাফ বলেন, “কোনো হেরিটেজ স্থাপনার আশে পাশে ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার আগে রাজউক যদি আমাদের সাথে পরামর্শ করে তাহলে অনেকগুলো সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।”