ঈদের পর ‘নাশকতার ছক’ কষছিল আল কায়েদা

আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখার দুই শীর্ষ নেতাসহ ১২ জনকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও সরঞ্জামসহ আটক করা হয়েছে, যারা ঈদের পর রাজধানীতে নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল বলে র‌্যাবের দাবি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 July 2015, 12:25 PM
Updated : 2 July 2015, 05:28 PM

র‌্যাবের তথ্য অনুযায়ী, আটকদের মধ্যে মাওলানা মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফে নানা ওরফে বদিউল (৩৫) একিউআইএস-এর বাংলাদেশ শাখার প্রধান সমন্বয়ক। একসময় তিনি হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর (হুজি) সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। আর আটক মুফতি জাফর আমিন ওরফে সালমান (৩৪) একিউআইএসের একজন উপদেষ্টা।

লেখক অভিজিৎ রায় ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ খুন হওয়ার পর ওই জঙ্গি সংগঠনের পক্ষ থেকেই দায়িত্ব স্বীকার করে বার্তা দেওয়া হয়েছিল।

বরাবরের মতোই এ জঙ্গি সদস্যদের আটকের কথা প্রথমে গণমাধ্যমকে জানানো হয় র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখা থেকে এসএমএস পাঠিয়ে। পরে বৃহস্পতিবার দুপুরের আগে উত্তরায় বাহিনীর সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করে র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের বিভিন্ন তথ্য জানান।

তিনি বলেন, র‌্যাব-৪ এর একটি দল ‘গোপন তথ্যের ভিত্তিতে’ বুধবার ভোর সাড়ে ৬টার দিকে সদরঘাটে অভিযান চালিয়ে প্রথমে মাওলানা মঈনুল, মুফতি জাফর, একিউআইএস বাংলাদেশ শাখার সদস্য মো. সাইদুল ইসলাম ওরফে সাইদ তামিম (২০), মো. মোশাররফ হোসেন (১৯) ও আব্দুর রহমান বেপারীকে (২৫) আটক করে।

পরে তাদের দেওয়া তথ্যে বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় খুলনা থেকে আসা একিউআইএস বাংলাদেশের সদস্য আলামিন ওরফে ইব্রাহিম (২৮), মো. মুজাহিদুল আসলাম ওরফে নকীব ওরফে শরীফ (৩১), আশরাফুল ইসলাম রওফে আবুল হাশেম (২০), রবিউল ইসলাম ওরফে হাসান (২৮) ও মো. জাবিবুল্লাহকে (২৬) গ্রেপ্তার করা হয়।

এরপর মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের বর্ধনবাড়ি থেকে মো. শহীদুল ইসলাম ওরফে সাগর (২৯) ও আলতাফ হোসেন ওরফে আল মামুনকে (২৬) আটক করে র‌্যাব।

ওই বাড়িতে পাওয়া যায় আড়াই লিটার সালফিউরিক এসিড, এক কেজি সালফার, ৪০০ গ্রাম পটাশিয়াম ক্লোরাইড, ৫৫০টি মার্বেল, উগ্র মতবাদসম্বলিত বিভিন্ন ধরনের বই, ১৬টি মোবাইল ফোন সেট, চারটি নান চাকু, পাঁচটি ছুরি, একটি চাপাতি, দুটি চায়নিজ কুড়াল, এক কার্টন দেশলাই, ১৫টি বিস্ফোরক ডিভাইস এবং ১০টি ছোট ছুরিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম।

মুফতি মাহমুদ খান বলেন, “ঈদের পর রাজধানীতে নাশকতা সৃষ্টির জন্য এরা ঢাকায় জড়ো হচ্ছিল। নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তারা মিরপুরে একটি বাসাও ভাড়া করেছিল। তাদের বেশিরভাগই আসছিল বরিশাল ও খুলনা থেকে।”

র‌্যাব বলছে, আটক এই জঙ্গি সদস্যরা এক সময় নিষিদ্ধ সংগঠন হুজিতে সক্রিয় ছিলেন। ব্রিটিশ হাই কমিশনারের উপর বোমা হামলার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হুজির শীর্ষ নেতা মওলানা মুফতি মঈনুদ্দীন ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ কাশিমপুর কারাগার থেকে মোবাইল ফোন ও চিঠির মাধ্যমে আত্মগোপনে থাকা এই নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

তার নির্দেশনা অনুযায়ী এই জঙ্গি সদস্যরা প্রথমে ‘দাওয়াতে তাবলীগ’ এবং পরে ‘৩১৩ বদরের সৈনিক’ নামে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা চালাচ্ছিল বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

মুফতি মাহমুদ বলেন, “আটকরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, আল কায়েদার বিস্তার সামনে রেখে বাংলাদেশে সর্বাত্মক কার্যক্রম শুরু হলে তারা একিউআইএসে যোগ দেবে- এটাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।”

তারা আল ‘কায়েদা প্রধানের ভিডিওবার্তা ও আইএস জঙ্গিদের কার্যক্রম’ দেখে আরও ‘তৎপর হয়ে উঠার’ চেষ্টায় ছিলেন বলেও র‌্যাবের মুখপাত্রের দাবি।

তিন ধাপে কর্মী সংগ্রহ

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় ‘অনেকটা চাপে’ থাকায় নতুনভাবে কর্মী সংগ্রহ শুরু করেছিল আটক জঙ্গিরা। ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেইসবুক, টুইটার, ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ‘দাওয়াতি কার্যক্রম’ চালানোর পরিকল্পনায় ছিল তারা।

মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘দাওয়াতি তাবলীগ’-এ মূলত তিন ধাপে কর্মী সংগ্রহ হত। ফেইসবুকে উগ্রপন্থি ওয়েবসাইটে ‘লাইক’ দিলে তাদের বলা হত ‘দ্বীন কায়েমের সাথী’।

দ্বিতীয় ধাপ হলো- ‘বায়াতে ফি ছাবিলিল্লাহ’। যারা ‘আল্লাহর পথে দাওয়াতি কার্যক্রম’ চালাতে অঙ্গীকারাবদ্ধ, তারাই ওই নামে পরিচিত হতো।

আর ওই সংগঠনের তৃতীয় ধাপ হলো ‘শহীদি কাফেলা’। যাদের ঈমান ‘শক্ত’ এবং জিহাদে ‘শহীদ’ হওয়ার জন্য প্রস্তুত, তারাই শহীদি কাফেলার আন্তর্ভুক্ত বলে আটকরা র‌্যাবকে জানিয়েছেন।  

আটকরা ‘৩১৩ বদরের সৈনিক’ নামে যে সংগঠন করার কথা ভেবেছিলেন, তার ২০ জনের একটি দল বগুড়ায় ২০ দিনের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন।

সেই প্রশিক্ষণের বিভিন্ন ‘ট্রেনিং ম্যানুয়ালও’ উদ্ধার করা হয়েছে বলে র‌্যাবের ব্রিফিংয়ে জানানো হয়।

মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘৩১৩ বদরের সৈনিক’ এর অর্থ যোগানদাতা রফিক নামের এক ব্যক্তি, যিনি সৌদি আরব ও দুবাই থেকে ‘ফিদাই মওলা’ নামে ফেইসবুক ব্যবহার করেন।

“আটকরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ড্রেনের রড কেটে হুজি নেতা মাওলানা মাঈন উদ্দিনকে মুক্ত করার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু পরে তারা ওই পরিকল্পনা থেকে সরে এসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নাশকতার পরিকল্পনা করে।”

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান, উপ-পরিচালক রুম্মান মাহমুদ ও সহকারী পরিচালক মাকসুদুল আলমসহ বাহিনীর উচ্চ  পর্যায়ের কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।