জটিলতা শিক্ষা সচিবের ‘মাতবরিতে’

মন্ত্রীর নির্দেশনা অমান্য করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে সব কলেজকে ডিজিটাল পদ্ধতি অনুসরণে বাধ্য করে শিক্ষা সচিব ভর্তি প্রক্রিয়ায় সংকট তৈরি করেছেন বলে জোরালো অভিযোগ উঠেছে।

শহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 June 2015, 04:44 PM
Updated : 29 June 2015, 03:15 AM

ভর্তির ফল প্রকাশে তিন দিন দেরি হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, মন্ত্রীর লিখিত নির্দেশনা অমান্য করে তার অনুপস্থিতিতে শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান ভর্তি নীতিমালা জারি করেন।

অনলাইনে সব কলেজে ভর্তির নির্দেশনা জারি করা হলেও সংশ্লিষ্ট সফটওয়্যার শিক্ষার্থী সংখ্যার ভারে অকার্যকর হয়ে পড়ে।

মন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে চললে সব শিক্ষার্থী ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আসত না। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তাতে তৈরি করা সফটওয়্যারটিতে সমস্যা হত না। কারণ, গতবছর মন্ত্রীনির্দেশিত পদ্ধতিতে ফল মিলেছিল। 

যোগাযোগ করেও মন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষা বিষয়ে শিক্ষা সচিবের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এর আগে ভর্তির ফল প্রকাশে জটিলতার সব দায় তার নিজের বলে জানিয়েছিলেন সচিব নজরুল।

গত ২৫ জুন একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির মেধা তালিকা প্রকাশের কথা থাকলেও কারিগরি জটিলতায় রোববারও তা প্রকাশ করতে পারেনি আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটি; কবে-কখন এই তালিকা প্রকাশ করা হবে, তাও বলতে পারছেন না কেউ।

বুয়েটের আইআইসিটি-কে একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তির আবেদনপত্র সমন্বয় করে মেধা তালিকা প্রণয়নসহ সার্বিক দায়িত্ব দেওয়া হয়।

গত ১৬ মে বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোতে (ব্যানবেইজ) শিক্ষা সচিবের সভাপতিত্বে ভর্তি নীতিমালা নিয়ে সভা হয়।

এই শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে দেখা দিয়েছে জটিলতা

মন্ত্রণালয়ের ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মর্তারা জানান, শিক্ষা সচিব ওই সভার কার্যপত্র ২৫ মে অনুমোদন দিয়ে ভর্তি নীতিমালা চূড়ান্ত করতে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে নথি উপস্থাপন করে চূড়ান্ত অনুমোদন চান।

ভর্তি নীতিমালায় চূড়ান্ত অনুমোদন না দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নিজের হাতে লিখেন, “যে সকল প্রতিষ্ঠান দুর্বল, পশ্চাদপদ এবং শিক্ষার্থী পায়নি তাদের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আগামীতে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। গত বছর ৫০০ আসন বিশিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই আওতায় (অনলাইন ও এসএমএসের মাধ্যমে ভর্তি) ছিল। এবার ৩০০ আসন বিশিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনলাইন বা এসএমএসের মাধ্যমে আবেদন প্রযোজ্য করা যায়।”

শিক্ষামন্ত্রীর এই নির্দেশনা আমলে নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গত ৩১ মে সচিবের কাছে নোট উপস্থাপন করেন, “অনুচ্ছেদের ৫৯ এর আলোকে খসড়া অনুচ্ছেদ ৪ এর সংধোশন করা হয়েছে। সচিব মহোদয়ের সদয় স্বাক্ষরের জন্য উপস্থাপন করা হলো।”

শিক্ষা সচিবের স্বাক্ষরে ১ জুন ভর্তি নীতিমালা জারি করা হয়।

ওই নীতিমালার ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, “যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম ৩০০ জন শিক্ষার্থী আছে সেসব প্রতিষ্ঠানে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিতে অনলাইন বা টেলিটক মোবাইল এসএসএমের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানে ৩০০ জনের কম শিক্ষার্থী আছে সেসব শিক্ষার প্রতিষ্ঠানও অনলাইনে ভর্তির কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারবে।”

মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কাউকে কিছু না জানিয়ে গত ২ জুন শিক্ষা সচিব পুনরায় ভর্তি নীতিমালা জারি করেন।

নতুন করে জারিকৃত নীতিমালার ৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়, “শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য অনলাইনে অথবা টেলিটকে মোবাইল এসএমএম এর মাধ্যমে আবেদন করতে হবে।”

অনলাইনে আবেদনের জন্য নতুন করে ওয়েবসাইটের ঠিকানাও নতুন ভর্তি নীতিমালায় তুলে দেওয়া হয়।

নতুন করে ভর্তি নীতিমালা জারি করার সব শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে অনলাইন বা এসএমএসে আবেদন করতে হয়েছে। ১২ লাখ শিক্ষার্থীর আবেদন সমন্বয় করতে গিয়েই তৈরি হয়েছে জটিলতা।

ভর্তি ফলের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নোটিস

ঢাকা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা জানান, আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির প্রস্তাব ছিল যেসব কলেজে ৫০০ আসন রয়েছে তাদের বাধ্যতামূলকভাবে অনলাইনে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো। এছাড়া ৩০০ আসনের কলেজগুলোকে অনলাইনে ভর্তি করাতে তাদের ইচ্ছের উপর ছেড়ে দেওয়া।

“শিক্ষা বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তাদের পাশ কাটিয়ে শিক্ষা সচিব নিজেই ভর্তি সংক্রান্ত সব কার্যক্রম দেখভাল শুরু করেন। কারিগরি জটিলতা সারাতে অধ্যাপক কায়কোবাদের সঙ্গে এটুআইয়ের কর্মকর্তাদের বুয়েটে পাঠান তিনি।”

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আবু বক্কর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এবার মোট ১১ লাখ ৫৬ হাজার শিক্ষার্থী একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন করেছে। তবে একাধিক আবেদন করার সুযোগ থাকায় আবেদন জমা পড়েছে মোট ৩৩ লাখ।

শুধুমাত্র ৫০০ আসনের কলেজগুলোতে অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম সারার বাধ্যবাধকতা রাখা হলে সার্ভারে জটিলতা কম হতো বলে মনে করেন আবু বক্কর।

এরপরেও কেন সব কলেজকে অনলাইনে আবেদন নিতে বাধ্য করা হলো- এমন প্রশ্নে আবু বক্কর বলেন, “এটা এখন বলে কোনো লাভ নেই, দেখা যাক।...বুয়েটের আইআইসিটিতো বার বারই দায়িত্ব নিয়ে বলেছে আমরা পারব, পারবই।”

আবু বক্কর বলেন, “১ জুলাইয়েই ক্লাস শুরু হবে। শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে আমাকে নির্দেশনা দিয়েছেন। রোববার ফল প্রকাশিত হলে শিক্ষার্থীরা ভর্তিতে দুই দিন সময় পাবে।”

সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠান শেষে শিক্ষা সচিব সাংবাদিকদের বলেন, “সব কলেজকে অনলাইনের আওতায় আনতে আমার ভূমিকা ছিল। আমিই সব কিছুর জন্য দায়ী, আমার বিরুদ্ধে লিখেন কোনো অসুবিধা নাই।

“বিদেশ থেকে সফটওয়্যার না কিনে বুয়েট থেকে সফটওয়্যার বানানো হয়েছে। এতে নিজেদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে। আর প্রথম এই কাজটা করা হচ্ছে।”

কখন ভর্তির ফল দেওয়া হবে তা নিশ্চিত করে না জানিয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, “যন্ত্রপাতির ব্যাপার, অনুমান করে কথা বলতে হয়। প্রত্যেকটা কাজই রিস্কি।”

“...আইটির বিষয় ভালো বুঝি না,” বলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই’র এর সাবেক এই প্রকল্প পরিচালক।

অবশেষে রোববার মধ্যরাতে কারিগরি জটিলতা শেষে শিক্ষার্থীদের অপেক্ষার অবসান হয়। রাত পৌনে ১টার দিকে যে তালিকা প্রকাশ করা হয়ে তাতে মনোনীত হয়েছেন ১০ লাখ ৯৩ হাজার ৩৭৪ জন, যারা প্রথম দফায় ভর্তির সুযোগ পাবেন।