ব্লগার হত্যা: জড়িতদের ‘খুঁজতেই’ মাস-বছর পার

রাজধানীতে পরপর কয়েকজন ব্লগার ও লেখককে হত্যা করা হলেও জড়িতদের ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্যই পাচ্ছে না পুলিশ, যদিও একটি হত্যাকাণ্ডে জড়িত দুই জনকে হাতেনাতে আটক করা হয়েছিল।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 June 2015, 12:19 PM
Updated : 28 June 2015, 12:03 PM

পুলিশ বলছে, ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ায় খুনিদের চিহ্নিত করতে সময় লাগছে।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলার বাইরে টিএসসি এলাকায় অভিজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হামলাকারীর চাপাতির আঘাতে আহত হয়ে আঙুল হারান তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।

এ ঘটনার পরদিন সকালে তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অজয় রায় শাহবাগ থানায় মামলা করেন, যার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিল মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

গোয়েন্দা পুলিশকে তদন্তে সহায়তা করতে এফবিআইয়ের প্রতিনিধিদলও হত্যার কিছু আলামত পরীক্ষার জন্য নিয়ে গিয়েছিল। তবে সেগুলো তারা এখনো গোয়েন্দা পুলিশকে বুঝিয়ে দেয়নি।

অভিজিৎ ও বন্যা দুই জনই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। লেখালেখির কারণে জঙ্গিবাদীদের হুমকি মাথায় নিয়েই বাংলাদেশে এসেছিলেন অভিজিৎ।

এই হত্যায় সরাসরি জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারলেও অভিজিৎকে হত্যার উসকানি দেওয়ার অভিযোগে এরই মধ্যে শফিউর রহমান ফারাবি নামে একজন উগ্রপস্থি ব্লগারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ পরিদর্শক ফজলুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুলিশ ধারণা করছে আনসারউল্লাহ বাংলাটিমের সদস্যরাই অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেছে। হত্যাকারীরা ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে কাজ করে অর্থ্যাৎ খুন যে গ্রুপটি করে তাতে অংশ নেওয়া কেউ কারো পরিচয় জানে না।”

কিছুটা দেরিতে হলেও খুনিদের পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারবে বলে আশা করছেন তিনি।

ফজলুর রহমান জানান, এফবিআইয়ের প্রতিনিধি দল মামলার কিছু আলামত পরীক্ষার জন্য নিলেও তার ফলাফল এখনো জানা যায়নি।

অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের এক মাসের মাথায় খুন হন ওয়াশিকুর রহমান বাবু নামে আরেক ‘অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট’। অভিজিতের মতো ওয়াশিকুরও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের সক্রিয় প্রতিবাদও করেছিলেন তিনি।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বেগুনবাড়িতে এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই জনতা ধাওয়া করে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল নামের দুই মাদ্রাসাছাত্রকে ধরে ফেলে। পরে তাদের পুলিশে সোপর্দ করা হয়। তিন হামলাকারীর মধ্যে এই দুইজন ছিলেন বলে স্থানীয়দের দাবি।

পরদিন বাবু হত্যার ঘটনায় চার জনকে আসামি করে নিহতের ভগ্নিপতি তেঁজগাও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি মামলা করেন।

গ্রেপ্তার হওয়া জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ছাড়াও আবু তাহের ও মাসুম নামে দুইজন এই মামলার আসামি।

২৭ বছর বয়সী ওয়াশিকুর তেজগাঁও কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে মতিঝিলের ফারইস্ট এভিয়েশন নামের একটি ট্র্যাভেল এজেন্সিতে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন। তার বাবার নাম টিপু সুলতান, বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর গ্রামে।

সামহোয়্যারইন ব্লগে ‘বোকা মানব’ নামে একটি অ্যাকাউন্ট থাকলেও তিনি মূলত লেখালেখি করতেন ফেইসবুকের কয়েকটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে।

এ বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, “ব্লগার বাবু হত্যায়ও আনসারউল্লাহ বাংলাটিমের সম্পৃত্তরা রয়েছে বলে পুলিশ অনেকটাই নিশ্চিত। বাবু হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া দুইজনকে জনতা আটক করে পুলিশে দিয়েছিল। হত্যার পরিকল্পনায় অংশ নেওয়া আবু তাহেরকেও যাত্রাবাড়ি থেকে একটি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। এখন হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী মাসুমকে খুঁজছে পুলিশ।”

ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ফেইসবুকে লেখালেখিতে সক্রিয় আহমেদ রাজীব হায়দারকেও খুন করা হয়েছিল একই কায়দায়। ওই হত্যামামলায় আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধান মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানীর বিচার চলছে।

গত ১৮ মার্চ হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পর ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. রুহুল আমিন আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। 

আসামিদের মধ্যে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানী ছাড়া বাকিরা নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস বিভাগের ছাত্র। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।

মামলার প্রধান আসামি রেদোয়ানুল আজাদ রানা ছাড়া সবাই অভিযোগ গঠনের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রানা মামলার শুরু থেকেই পলাতক।  

বাকি ছয় আসামি হলেন- সাদমান ইয়াছির মাহমুদ, ফয়সাল বিন নাঈম দীপ, এহসান রেজা রুম্মান, মাকসুদুল হাসান অনিক, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজ।

ফাইল ছবি: রাজীব হায়দার

২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলন শুরুর দশম দিনে ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর মিরপুরে নিজের বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রাজীবকে। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে।

তদন্ত শেষে গত বছরের ২৮ জানুয়ারি আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি)  পরিদর্শক নিবারণ চন্দ্র বর্মণ।

অভিযোগপত্রে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষী করা হয় ৫৫ জনকে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে দুটি মসজিদে জুমার খুতবায় ধর্মের বিরুদ্ধে লেখে এমন ব্লগারদের হত্যার ফতোয়া দিতেন। অন্য আসামিরা সবাই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং তারা ওই খুতবা শুনতেন। এভাবে তাদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি হয়।

জসীমউদ্দিনের লেখা বই পড়ে এবং সরাসরি তার বয়ান ও খুতবা শুনে বাকি আসামিরা ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ খুন করতে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত হন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ব্লগার রাজীব খুন হন। রাহমানিকে ওই হত্যাকাণ্ডে উৎসাহদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

পেশায় স্থপতি রাজীব ব্লগ লিখতেন ‘থাবা বাবা’ নামে, যেখানে ধর্মান্ধতা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতাকারীদের বিপক্ষে লিখতেন তিনি।

আসামিদের মধ্যে জসীমকে ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বাকিদের গ্রেপ্তার করা হয় তার আগে মার্চ থেকে অগাস্টের মধ্যে।

মুফতি জসীমের উসকানিমূলক খুতবার বিষয়টি ছাত্রদের জবানবন্দিতেও উঠে এসেছে।

গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অপরাধীরা যত কৌশলই অবলম্বন করুক না কেন তারা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারবে না। ব্লগার হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশের আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। খুব দ্রুত খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে।”