বদরপ্রধান মুজাহিদের ফাঁসি বহাল

সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সাজা বহাল থাকায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিকাষ্ঠেই যেতে হবে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে।

মহিউদ্দিন ফারুকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 June 2015, 03:08 AM
Updated : 30 Sept 2015, 11:28 AM

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার মাত্র দুই মিনিটে এই রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দেন। আর সর্বোচ্চ সাজার এই রায় আসে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টায় বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে।  

এই বেঞ্চের বাকি তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

এই প্রথম বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করা কোনো ব্যক্তি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলতে যাচ্ছেন। বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়েও এটাই সর্বোচ্চ আদালতের প্রথম রায়।

বিগত চার দলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মুজাহিদই যে চার দশক আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণকে দমাতে গঠিত আলবদর বাহিনীর মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তা উঠে আসে এ মামলার রায়ে।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এক বছর পর আপিলে সেই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সাব্যস্ত হল।

২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের মধ্যে  মুজাহিদ হলেন চতুর্থ ব্যক্তি, আপিল বিভাগে যার মামলার নিষ্পত্তি হল।

২১ অগাস্ট গ্রেনেড মামলায় হাজিরার জন্য মুজাহিদকে আগের দিন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। আপিল বিভাগ যখন যুদ্ধাপরাধ মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করছে, ৬৭ বছর বয়সী এই জামায়াত নেতা তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।  

মুক্তিযুদ্ধকালীন আলবদর বাহিনীর কমান্ডার আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় বহাল থাকায় আদালতের বাইরে এ মামলার সাক্ষী ও মুক্তিযোদ্ধারা সন্তোষ প্রকাশ করেন। আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরণ হয় তার নিজের জেলা ফরিদপুরে। 

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মুজাহিদের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ এ মামলায় ছিল না বলেই তিনি মনে করেন। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পেলেই তারা রিভিউ আবেদন করবেন।

অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেন, আসামি মুজাহিদের ফাঁসির রায় এসেছে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে। এই রায়ে বাংলাদেশের সবাই খুশি হবে।

“এক শতাব্দীতে এরকম বুদ্ধিজীবী তৈরি হবে না। তবে এইটুকু সান্ত্বনা, বিচার পাওয়া গেল।”  

মুজাহিদের নির্দেশেই সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ কয়েকজনকে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।

শহীদ আলতাফের মেয়ে শাওন মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজকের রায়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন রায় থেকেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে, একদিন রাজাকারমুক্ত হবে।”

রায়

প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণের পর হত্যা এবং ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবীসহ গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ওই দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়েছিল বিচারিক আদালত।

একই রায় এসেছিল সপ্তম অভিযোগে, ফরিদপুরের বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায়।

আপিল বিভাগের রায়ে আপিল আংশিক মঞ্জুর করে প্রথম অভিযোগে আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে। সপ্তম অভিযোগে তার সাজা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।  

আর ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখে মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।  

মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে ১৯৭১ সালের ১৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের ভেতরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিকসহ বহু খ্যাতিমান বাঙালিকে হত্যা করে।

পরে শরীরে নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিহ্নসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের লাশ পাওয়া যায় মিরপুর ও রায়েরবাজার এলাকায়। পরে তা বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।

মুজাহিদ মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে ওই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রে অংশ নেন বলে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে।

এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, “অভিযুক্ত সচেতনভাবে এবং নিজের কর্তৃত্ব কাজে লাগিয়ে আলবদর সদস্যদের উপর প্রভাব খাটিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধে সহায়তা ও ভূমিকা রেখেছেন। এমনকি এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রণয়নেও ভূমিকা রাখেন তিনি।

“তার কাজ ও নিন্দনীয় আচরণ পরিষ্কারভাবেই এ হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী নিপীড়কদের প্ররোচনা ও সহায়তা জুগিয়েছে, আইনের ৪(১) ধারা অনুযায়ী যা তাকেও সহ-নিপীড়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। একইসঙ্গে ইসলামী ছাত্র সংঘে তার অবস্থানের কারণে তিনি এ পরিকল্পনার অংশ ছিলেন এবং আলবদরের সব অপরাধ সম্পর্কে অবগত ছিলেন বলে আইনের ৪(২) ধারা অনুযায়ী সেসব অপরাধের জন্য তিনিও দায়ী।”

পঞ্চম অভিযোগে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, গেরিলা যোদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল, শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছেলে শাফি ইমাম রুমি, বদিউজ্জামান, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ও মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদসহ কয়েকজনকে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে আটকে রেখে নির্যাতন এবং জালাল ছাড়া বাকিদের হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার জন্য ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদকে দেয়া হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আপিল বিভাগের রায়ে সেই সাজাই বহাল রাখা হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের রায়ে তৃতীয় অভিযোগে ফরিদপুর শহরের খাবাসপুরের রণজিৎ নাথকে অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় মুজাহিদকে। ওই সাজা তার প্রাপ্য বলে আপিল বিভাগও মনে করেছে। 

এখন যা হবে

নিয়ম অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর তা ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। সেটি হাতে পেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে ট্রাইব্যুনাল। সেই মৃত্যু পরোয়ানা ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনাবে কারা কর্তৃপক্ষ।

পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবে আসামিপক্ষ। তবে রায়ের নির্ভরযোগ্যতায় ‘খাদ আছে’ বা ‘বিচার-বিভ্রাটের’ আশঙ্কা আছে বলে মনে করলেই আদালত তা পুনর্বিবেচনার জন্য গ্রহণ করবে। 

রিভিউ যে আপিলের সমকক্ষ হবে না, তা যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ‘রিভিউ’ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়েই স্পষ্ট করা হয়েছে।

রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি হয়ে গেলে এবং তাতে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে আসামিকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে। তিনি স্বজনদের সঙ্গে দেখাও করতে পারবেন।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গেলে সরকার কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। 

দুই জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের রায় বাস্তবায়নের আগে পালিত প্রক্রিয়াগুলো এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসাবে থাকছে।

ন্যায়বিচার ‘হয়নি’

রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হবে জানিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মুজাহিদের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, যে অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে, সেই অভিযোগের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, তা অত্যন্ত দুর্বল এবং তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আপিল বিভাগ রিভিউয়ের সময় অবশ্যই এটি বিবেচনা করবেন।”

মুজাহিদের ছোট ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর বলেন, “যেহেতু আমরা ট্রাইব্যুনালে জাস্টিজ পাই নাই, তাই আপিল বিভাগে এসেছিলাম। আশা করেছিলাম আমরা ন্যায়বিচার পাব। আজকে যে রায় হল, তাতে আমরা ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হয়েছি।”

আর বদরপ্রধান মুজাহিদের বড় ভাই ফরিদপুর জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির আলী আফজাল মোহম্মদ খালেছের দাবি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে ‘সাক্ষী সাজিয়ে’ এই রায় এসেছে।

“সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে দেওয়া এ রায় আমাদের পরিবার প্রত্যাখ্যান করেছে।”

‘কলঙ্কমোচন’

রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “আজকে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ব্যাপারে যে রায় আমরা পেলাম, তাতে সারা দেশের বুদ্ধিজীবীরা, এদেশে সংস্কৃতির চর্চা যারা করেন, যারা আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি সমুন্নত রাখেন, এবং যারা আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সমুন্নত রাখার স্বপ্ন দেখেন, তারা সবাই খুশি হবে।”

জাতিকে মেধাশূন্য করার সেই ষড়যন্ত্রের চেয়ে বড় অপরাধ আর হয় না মন্তব্য করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “হিটলারের যে হিংস্রতা এবং এদের যে হিংস্রতা, তাতে আমি কোনো তফাৎ দেখি না।”

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ‘পূর্ণতার দিকে’ অগ্রসর হওয়াকে বাংলাদেশের ‘সভ্যতার দিকে’ এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেন।

তিনি বলেন, “প্রতিটি রায়ের মাধ্যমে আমরা ধাপে ধাপে সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

এ মামলায় সাক্ষ্য দেন একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা বিচ্ছু জালাল, যিনি ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে মুজাহিদের সহযোগীদের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।  

আপিলের রায়ের পর তিনি বলেন, “এই রায়ে আমি খুশি। রায় কার্যকর হলে যদি আমার সহযোদ্ধা বদি-রুমী-আজাদ ভাই, আলতাফ মাহমুদ ভাইয়ের আত্মা শান্তি পায় তাহলে আরও খুশি হব।”

সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগ থেকে আপিল বিভাগ মুজাহিদকে খালাস দিলেও সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীর ছেলে সাংবাদিক জাহিদ রেজা নূর মনে করছেন, ফাঁসি বহাল থাকায় জাতি ‘কলঙ্কমুক্ত’ হল।

“একাত্তরে তারা যে নৃশংসতা চালিয়েছে তা তো নজিরবিহীন। তারা পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলেমিশে পুরো একটা জাতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে।... এমন একটা অতীত জিইয়ে রেখে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না।”

চূড়ান্ত রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, “আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে মুজাহিদ বের হয়ে যেতে পারেন বলে আশঙ্কা ছিল। আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে সেই আশঙ্কা দূর হয়েছে।”

এখন রায় দ্রুত কার্যকর করা হলে ‘মানুষের অপেক্ষার অবসান হবে’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এ মামলার তৃতীয় অভিযোগে ফরিদপুরের রণজিৎ নাথকে অপহরণ ও নির্যাতনের দায়ে মুজাহিদকে দেওয়া হয়েছে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। রণজিৎ নিজেও এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন।

আপিলের রায়ের পর তিনি বলেন, “মুজাহিদের জন্য সব সময় খুব ভয়ে থাকতাম। এখন আমি শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারছি।”

ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার আসামি ফরিদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার নূর মোহাম্মদ বলেন, “দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের আশার প্রতিফলন ঘটেছে। এমনটিই আমরা চেয়েছিলাম।”

বদর নেতা থেকে মন্ত্রী

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি, ফরিদপুর জেলার পশ্চিম খাবাসপুরে। ১৯৬৪ সালে মাধ্যমিক পাসের পর তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন এবং উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকাকালেই জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তাকে সংগঠনের জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়।

১৯৭১ সালে বাংলার মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেই বছর জানুয়ারিতে ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি হন মুজাহিদ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর জুলাই মাসে সংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারির এবং এরপর প্রাদেশিক সভাপতির দায়িত্ব পান।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠিত হলে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার নেতৃত্ব দেন ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার সভাপতি ও জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী। অক্টোবরে ওই বাহিনীর প্রধান হন মুজাহিদ।

তার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী যুদ্ধের মধ্যে ফরিদপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায় বলে আদালতের রায়ে উঠে এসেছে। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির সময়ও বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন মুজাহিদ।

একাত্তরে তার কর্মকাণ্ডের ঘনিষ্ঠ সহযোগী পলাতক আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকেও যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

স্বাধীনতার পর মুজাহিদ জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং ১৯৮২ সালে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য হন। ১৯৮৯ থেকে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনের পর ২০০০ সালে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হন তিনি।

কোনো নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলেও বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান মুজাহিদ। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের পরিচালনা পর্ষদেরও প্রধান ছিলেন তিনি।

যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২০১০ সালের মার্চে জামায়াতে ইসলামীর এক সংবাদ সম্মেলনে মুজাহিদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের মতো কোনো ধরনের অপরাধে জামায়াত নেতারা জড়িত ছিলেন না।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করার পর ২ অগাস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

মামলার শুনানি শেষে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ২১ জুন ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদের বিচার শুরু হয়।

চতুর্থ রায়

ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত হওয়া ১৯টি মামলার রায়ের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৩টিতে দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আবুল কালাম আযাদ, চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান এবং ফরিদপুরের জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকার পলাতক থাকায় এ সুযোগ পাননি।

আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জাতীয় পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল জব্বারও একই কারণে আপিল করতে পারেননি।

মুজাহিদের মামলাসহ চূড়ান্ত রায় এসেছে চার মামলায়।

এর আগে গত ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সর্বোচ্চ সাজা দিলে চলতি বছর ১১ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। 

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং তার ঠিক এক বছর আগে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

আপিল শুনানি চলাকালেই মৃত্যু হয়েছে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের।

এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিল শুনানি শুরু হয়েছে মঙ্গলবার।