দূষণে ঝুঁকির মুখে হালদা

শিল্প ও আবাসিক বর্জ্য দূষণের মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় কার্প জাতীয় মাছের অন্যতম প্রজননকেন্দ্র চট্টগ্রামের হালদা নদী।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 June 2015, 08:02 AM
Updated : 8 June 2015, 08:44 AM

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক বছরে দূষণের কারণে নদীর কয়েকটি অংশে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমেছে; বেড়েছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, যে পরিস্থিতি মাছসহ জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য প্রতিকূল।

দূষণের কারণে হালদায় মাছের রেণু উৎপাদন এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে; নদীর বিভিন্ন অংশে মরা মাছ ভাসছে।

হালদা বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দূষণের মাত্রা বাড়ছেই। এখনই ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে হালদার পরিণতি বুড়িগঙ্গার মত হবে।”

দূষণের চিত্র

এক বছর ধরে হালদার সঙ্গে যুক্ত কাটাখালি, খন্দকিয়া, বাথুয়া, শাহ মাদারি ও কৃষ্ণখালি খাল ধরে বিষাক্ত বর্জ্য এসে পড়ছে নদীতে।

স্থানীয়রা জানান, মদিনা ট্যানারি, রওশন ট্যানারি ও রিফ লেদার নামের তিন প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য কৃষ্ণখালি ও খন্দকিয়া খাল হয়ে নগরীর প্রান্তে মদুনাঘাট এলাকায় হালদা নদীতে মেশে।

এছাড়া এশিয়া পেপার মিলের বর্জ্য শাহ মাদারি খাল বেয়ে হাটহাজারী উপজেলার নন্দীরহাট এলাকায় হালদায় মিশছে। হাটহাজারী সদরের হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের বর্জ্য চেঙখালি খাল হয়ে নদীতে মিশছে।

এছাড়া চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ‘অনন্যা’ আবাসিক এলাকার কাটা মাটি ও অন্যান্য বর্জ্য প্রকল্পের মূল নালা হয়ে কুয়াইশ, কৃষ্ণ ও খন্দকিয়া খাল হয়ে হালদায় পড়ছে।

রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার ভেতর দিয়ে চলা প্রায় ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ হালদা নদী নগরীর প্রান্তে মোহরা অংশে কর্ণফুলীর সঙ্গে মিশেছে।

হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোয়াজ্জম হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মদিনা ও রওশন ট্যানারি, রিফ লেদার, কেডিএস ডাইং, এশিয়া পেপার মিল, হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট, ইব্রাহিম কটন মিল এবং অনন্যা আবাসিক এলাকার বর্জ্য হালদাকে দূষিত করছে।

হাটহাজারীর শিকারপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু বকর জানান, ট্যানারি বর্জ্য বছরখানেক আগেও হাজিরপুল হয়ে কালুরঘাট শিল্প এলাকার নালা হয়ে কর্ণফুলী নদীতে পড়ত।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন ওইসব এলাকার খাল-নালা ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্জ্য কৃষ্ণখালি ও খন্দকিয়া হয়ে হালদায় পড়ছে। পাশাপাশি অনন্যা আবাসিক এলাকার মাস্টার ড্রেনের পশ্চিম মুখ কুয়াইশ খাল হয়ে আমার ইউনিয়নের ভেতরের খালগুলো হয়ে হালদায় যাচ্ছে।”

কুয়াইশ খালের মুখে ও শহীদউল্লাহ পাড়ায় বাথুয়া খালে স্থানীয় উদ্যোগে বাঁধ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে আবু বকর বলেন, এভাবে বর্জ্য নদীতে পড়া হয়তো সাময়িক ঠেকানো যাবে। কিন্তু অনন্যা আবাসিক এলাকায় জনবসতি শুরু হলে দূষণ ঠেকানো যাবে না।

মরছে মাছ, কমছে রেণু

গত ১০ মে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রইছ উল আলম মণ্ডলের নেতৃত্বে খন্দকিয়া খালের মুখ ও নাপিতের ঘাট এলাকায় হালদার পানির নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়।

পরীক্ষায় মদুনাঘাট এলাকায় খন্দকিয়া খালের মুখে হালদার সংযোগ পয়েন্টে প্রতি লিটারে এক দশমিক তিন শূণ্য মিলিগ্রাম ডিও (দ্রবীভূত অক্সিজেন) পাওয়া গেছে, যেখানে অন্তত প্রতি লিটারে চার দশমিক পাঁচ শূন্য মিলিগ্রাম থাকা প্রয়োজন।

অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, “যে মাত্রার ডিও সেখানে পাওয়া গেছে তাতে কোনো মাছ বাঁচার কথা না।

“রাবার ড্যামের কারণে নদীর পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং নির্বিচারে মা মাছ নিধন চলছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে দূষণ। গত এক দশকে এবার রেণু উৎপাদন তাই সর্বনিম্ন পর্যায়ে ঠেকেছে।”

এই হালদা বিশেষজ্ঞের কথার সত্যতা মেলে রাউজান উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিনের মন্তব্যে।

তিনি বলেন, “খাল ও নদীর সংযোগ অংশগুলোতে বিভিন্ন সময় মাছ ভেসে উঠে এবং অল্প সময় পরে মারা যেতে দেখেছি। দূষণের কারণেই এমন হচ্ছে।”

চলতি বছর হালদায় মা মাছের দেওয়া ডিম থেকে মাত্র ৬৫ কেজির মত রেণু উতপাদিত হয়েছে বলে জানিয়ে নাজিম উদ্দিন বলেন, মে মাসের অমাবস্যায় বৃষ্টি না হওয়ায় মাছ দ্বিতীয়বার ডিম দেয়নি। এখন জুনের অমাবস্যায় বৃষ্টির আশায় আছেন ডিম সংগ্রহকারীরা। 

সরকারি হিসাবে, ২০১২ সালে নদী থেকে সংগৃহীত ডিমে রেণু হয়েছিল প্রায় এক হাজার ৬০০ কেজি। ২০১৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৬২৪ কেজিতে। সবশেষ ২০১৪ সালে এ পরিমাণ ছিল ৫০০ কেজি।

বিশেষজ্ঞরা হালদা নিয়ে চিন্তিত হলেও চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান রসায়নবিদ মিলন কুমার চক্রবর্তীর মতে, আশঙ্কার চেয়ে নদীর দূষণের পরিমাণ কমই।

তিনি বলেন, “যে ধরনের  ট্যানারি বর্জ্য ও অন্যান্য বর্জ্য পড়ছে, তাতে নদী আরও বেশি দূষিত হওয়ার কথা ছিল।

“কিন্তু হালদা নদী টাইডাল রিভার এবং কর্ণফুলীর সঙ্গে যুক্ত। জোয়ার-ভাটার কারণে অধিকাংশ বর্জ্যই সাগরে চলে যায়।”

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক মো. মকবুল হোসেন জানান, অনন্যা আবাসিক এলাকায় বসতি শুরু হলে দূষণ বেশি হবে। এ বিষয়ে সিডিএ, সিটি করপোরেশন ও ওয়াসাকে জানানো হয়েছে।

তিনি বলেন, “বর্জ্য ফেলে যেসব প্রতিষ্ঠান দূষণ করছে তাদের কয়েকটিকে নোটিস দিয়ে জরিমানা করা হয়েছে। নিয়মিত অভিযানে এবং অভিযোগ পেলে অবশ্যই এ ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”