ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়ে সংসদে প্রস্তাব পাস

বছরের পর বছর ঝুলে থাকা সীমান্ত জটিলতার অবসান ঘটানোয় ভারতের জনগণ এবং দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ সংসদ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 June 2015, 02:44 PM
Updated : 2 June 2015, 06:07 PM

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সফরে আসার চার দিন আগে মঙ্গলবার সংসদে এই ধন্যবাদ প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।

এই প্রস্তাবের উপর আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিবেশী দেশটির সক্রিয় সমর্থনের বিষয়টি  তুলে ধরে বলেন, “দুঃসময়ে ভারত সব সময় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে।”

মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ এবং শরণার্থীদের জায়গা দিয়ে সহায়তার কথা উল্লেখ করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে শেখ হাসিনা।

“সহায়তা করেছে বলেই মাত্র নয় মাসে স্বাধীনতা অর্জন করেছি।”

একাত্তরে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে ভারতের সহযোগিতার কথাও স্মরণ করেন শেখ হাসিনা।

বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদসহ সরকারি ও বিরোধী দলের ১৯ জন সংসদ সদস্য ধন্যবাদ প্রস্তাবের উপর বিশেষ আলোচনায় অংশ নেন।

বিএনপিবিহীন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসা করে বলেন, “তিনি নিজের আত্মপরিচয় দিতে দ্বিধা করেননি। এতে তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বোঝা যায়।”

ভারতের সঙ্গে অন্য যে সব সমস্যা রয়েছে, সেগুলোও একের পর এক সমাধান হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সংসদের বাইরে থাকা বিএনপিও স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকরে ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব রাজ্যসভা ও লোকসভায় পাস হওয়ায় ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর সফরকেও স্বাগত জানাচ্ছে তারা।

ছিটমহল এবং অপদখলীয় ভূমির বিরোধ নিষ্পত্তিতে ১৯৭৪ সালে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চুক্তি হলেও তা কার্যকর হচ্ছিল না এতদিন ধরে।

চুক্তি কার্যকরে বাংলাদেশের তরফে সব প্রক্রিয়া সারা হলেও ভূমি বিনিময়ের জন্য ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্যের জন্য ভারত তা পাস করতে পারছিল না।

সংবিধান সংশোধনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন মনমোহন সিংয়ের সরকারের ওই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয় সম্প্রতি বিজেপি নেতৃত্বাধীন নরেন্দ্র মোদী সরকারের হাত দিয়ে।

গত মাসে রাজ্যসভা ও লোকসভায় সীমান্ত বিল পাসের পরই বাংলাদেশে আসতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। তার সফরের ঠিক আগেই বাংলাদেশের আইনসভা এই ধন্যবাদ প্রস্তাব পাস করল।

আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে  ভারতের বিরোধীদলীয় নেতা সোনিয়া গান্ধী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যসভা ও লোকসভার সব সদস্যদের সঙ্গে ভারতের জনগণকে ধন্যবাদ জানান।

কংগ্রেস সরকার সীমান্ত বিল পাসের উদ্যোগ নিলেও তার মধ্যেই ভারতে নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল হয়। তাতে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তার সঙ্গে আলোচনার কথাও বলেন বাংলাদেশের সরকার প্রধান।

“মোদী সরকারে আসলে আমার সাথে দেখা হল আমেরিকায়। আমাকে কথা দিলেন, তিনি বিলটি পাস করে দেবেন। তিনি যে কথা দিলেন, সেই কথা রেখেছেন। তাকে আবার ধন্যবাদ জানাই বিলটি পাস করে দেওয়ায়।”

গত মে মাসের শুরুতে বিলটি লোকসভায় পাসের পর নরেন্দ্র মোদী নিজেই টেলিফোন করে শেখ হাসিনাকে জানিয়েছিলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, “পাস হওয়ার সাথে সাথে নরেন্দ্র মোদী আমাকে ফোন করেন। আমাকে জানান। তিনি আমাকে সম্মান জানান।”

সোনিয়া গান্ধী, সুষমা স্বরাজসহ বাংলাদেশলাগোয়া ভারতের রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের ফোন করে ধন্যবাদ জানানোর বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি কোনো প্রটোকলের দিকে তাকাইনি।

“আমি এখন পার্লামেন্টের মাধ্যমে ধন্যবাদ জানালাম।”

মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “তিনি বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিরাট উপহার নিয়ে আসছে, সীমান্ত চুক্তি।”

ভারত এই বিলটি পাস করায় ছিটমহলবাসী অন্তত একটা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি পাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

“বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে অনেক আগেই এই চুক্তি হয়ে যেত,” বলেন শেখ হাসিনা।

আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। সেই অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে কাজ চালাচ্ছে তার  সরকার।

“সকলের শত্রু দারিদ্র্যকে দূর করতে সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে। এজন্য, পারস্পরিক বন্ধুত্বকে গুরুত্ব দিতে হবে।”

ফাইল ছবি

আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয়  পার্টির নেতা রওশন প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনার বাবা নেই, তার কাজগুলো আপনাকে করতে হবে। আপনি তা করেও যাচ্ছেন।

“আপনাকে একের পর এক কাজ করতে হবে। ভালো কাজ করতে গেলে বাধা আসবে। আর, মহিলাদের ক্ষেত্রে বাধা বেশি। সেই বাধা ভেঙে এগিয়ে যেতে হবে। সোনার বাংলা আপনাকে গড়ে তুলতে হবে।”

শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, “বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়ে সম্পন্ন করছেন।”

“তারা ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। ১৬ বছর কী দিয়েছে,” বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বলেন তিনি।

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ বলেন, “বঙ্গবন্ধু নেই। তার দুটি গুণ তার কন্যা গ্রহণ করেছেন। তিনি লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। আর, লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কাজ করেন।”

কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, “এখন আর ছিটমহলবাসী নেই। তারা অনাগরিক থেকে নাগরিক হয়েছেন।”

প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ বলেন, “কিছু আনন্দ আছে, যা হ্দয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। অজস্র ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।

“যে চুক্তির শুরু করেছিলেন মুজিব-ইন্দিরা, তা বাস্তবায়ন করছেন হাসিনা-মোদী। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু নরেন্দ্র মোদী আমাদের ১৬ কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে এগিয়ে এসেছে।”

ছিটমহলের মানুষদের নিয়ে একসাথে উৎসব পালনের ঘোষণা দিয়ে এরশাদ বলেন, “যারা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে গোলামীর চুক্তি বলেছিল, তাদের মুখে ছাই পড়বে।”

তিস্তাপারের জনপদের এরশাদ তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি দ্রুত করতে উদ্যোগী হতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আশা করি, তিস্তা সমস্যার সমাধান করবেন। আর তিস্তার বুকে গরুর গাড়ি চলবে না।”

আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে এই সব চুক্তি তো হতই না। এইসব চুক্তির নামও উচ্চারণ করতে পারতাম না। শেখ হাসিনা ছাড়া কারও পক্ষে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হত না।”

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এই আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, “আমরা চাই, দুই দেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর মীমাংসা হোক। অভিন্ন নদীর সমস্যার সমাধান হোক।”

এই আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, “এই ভারত মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সহায়তা করেছিল। আর বন্ধু দেশের বিরুদ্ধে আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দিয়েছিলাম।

“এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রধানমন্ত্রী শেখ সরিয়ে দিয়েছেন। এখন ভারতের জন্য বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশী। ভারতের উচিত শেখ হাসিনা সরকারকে সর্বময় সমর্থন করা।”

“আমরা ইনশাল্লাহ, তিস্তার পানি আদায় করব,” বলেন এই মন্ত্রী।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জোট শরিক দলের নেতা শেখ হাসিনার ‘কূটনৈতিক দূরদর্শিতার’ প্রশংসা করেন।

“আমরাও অভিন্ন নদীর পানির জন্য জাতিসংঘে যাওয়ার কথা, আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী আলোচনার মাধ্যমে গঙ্গার ন্যায্য হিস্যা আদায় করেন।”

ভারতের ভিসা পদ্ধতি সহজ করার উপরও জোর দেন তিনি।

নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের সফরের মধ্যে তিস্তা চুক্তির সম্ভাবনাও বাড়বে বলে মন্তব্য করেন পর্যটন ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী মেনন।

মোদীর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক একটি নতুন উচ্চতায় যাবে বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের মইনুদ্দিন খান বাদল ভারতের জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “ভারত বিশ্বসভায় মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান চায়। ভারত সিকিউরিটি কাউন্সিলে মেম্বারশিপ চায়। ভারতের এ যাত্রায় বড় ভূমিকা নিতে পারে বাংলাদেশ।”

ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, সংসদের প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ, সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন, হাসান মাহমুদ, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, তাহজিব আলম সিদ্দিকীও এই আলোচনায় অংশ নেন।

প্রধান হুইপ উত্থাপিত এই প্রস্তাবটি এরপর সবার সম্মতিতে পাস হয়।