এসএসসিতে এবার অস্থিরতার সঙ্গে গণিতের ধাক্কা

রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে উৎকণ্ঠা নিয়ে এক মাসের পরীক্ষা দুই মাসে শেষ করেছে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থীরা, তা বিবেচনায় নিয়েই এবার পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য গণিতকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

শহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 May 2015, 04:53 PM
Updated : 30 May 2015, 07:36 PM

টানা ছয় বছর ধারাবাহিকভাবে এসএসসিতে পাসের হার বাড়লেও এবার উল্টো চিত্রে গতবারের চেয়ে পাসের হার কমেছে ৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ পয়েন্ট; জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৩০ হাজার ৩৭৫ জন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ শিক্ষা বিভাগের কর্তা-ব্যক্তিরা রাজনৈতিক অস্থিরতাকে এজন্য দায়ী করলেও ফল বিশ্লেষণে দেখা যায় গণিতে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা।

এসএসসিতে এবারই প্রথম গণিত ও উচ্চতর গণিতে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষায় অংশ নেন শিক্ষার্থীরা। 

গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, শুধু গণিতে এবার পাসের হার কমেছে ৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ পয়েন্ট।

নতুন যোগ হওয়া আরও দুটি বিষয় উচ্চতর গণিত এবং শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও খেলাধুলাসহ মোট ২৩টি বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা হয়েছে এবার।

ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, গণিতে পাসের হার কমলেও পদার্থ বিজ্ঞানে শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ এবং রসায়নে শূন্য দশমিক ৯৮ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে। ইংরেজিতে এবার পাসের হার ৯৭ দশমিক ৩২ শতাংশ; গতবছর ছিল ৯৮ দশমিক ৫০ শতাংশ।

পদার্থ বিজ্ঞানে গতবছর পাসের হার ছিল ৯৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আর এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯ দশমিক ১২ শতাংশ।

রসায়নে গতবছর ৯৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করলেও এবার ৯৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।

প্রথমবারের মতো সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা হওয়া শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও খেলাধুলা বিষয়ে এবার পাসের হার ৯৯ দশমিক ৪২ শতাংশ।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শনিবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল তুলে দেন। ছবি: সাইফুল ইসলাম কল্লোল

পাসের হার কমার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আন্তঃবোর্ড সমন্বয় সাব কমিটির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শ্রীকান্ত কুমার চন্দ রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দায়ী করলেও সেইসঙ্গে গণিতের ফল খারাপ হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। 

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অন্য বিষয়গুলোতে পাসের হার ঠিক থাকলেও গণিতে পাসের হার কম।”

চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাসমত জাহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবার যারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে তারা শুধু নবম ও দশম শ্রেণিতে গণিতে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পড়েছিল।

“এতে তারা ভালোভাবে বিষয়টি আয়ত্ত করতে পারেনি। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে গণিতের ভালো শিক্ষকের সঙ্কট আছে।”

প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গণিতে ভালো মানের শিক্ষকের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীও।

প্রথমবারের মতো গণিতে সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এই পদ্ধতি কতটুকু রপ্ত করতে পেরেছে, তা নিয়েও সন্দিহান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিক্ষকরা নতুন পদ্ধতি কতটুকু রপ্ত করেছে? এ বিষয়ে তাদের কতটুকু প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে? যারা প্রশ্ন তৈরি করছেন, তাদের প্রশিক্ষণ কতটুকু হয়েছে তা দেখতে হবে।”

গণিতে পাসের হার কমে যাওয়াকে ‘আশঙ্কাজনক’ উল্লেখ করে এই বিষয়ে শিক্ষকদের দুর্বলতা রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান।

সার্বিক ফল পর্যালোচনায় তিনি বলেন, “শুধু পাসের হার বাড়ানো নয়, শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে হবে। এবার গণিতে পাসের হার কমে যাওয়ার ঘটনা এটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।”

শামসুল হক খান স্কুল ও কলেজে এই উচ্ছ্বাস দেশসেরা হওয়ার

দ্বিতীয় সেরা রাজউক স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা

এবছর মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় ৮৭ দশমিক ০৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে, যাদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৯০১ জন।

এবছর গণিতে সবচেয়ে খারাপ করেছে সিলেট শিক্ষাবোর্ডের শিক্ষার্থীরা। পাসের হারেও এই বোর্ড অন্য বোর্ডগুলোর তুলনায় পিছিয়ে।

সার্বিক ফলচিত্রে দেখা যায়, গণিতে সিলেট বোর্ডে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ০২ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এই বোর্ডে মোট পাসের হার গতবারের তুলনায় কমেছে ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ পয়েন্ট।

অন্যদিকে একই বিষয়ে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার কমেছে ৫ দশমিক ২০ শতাংশ পয়েন্ট, রাজশাহীতে ২ দশমিক ২৭ শতাংশ পয়েন্ট এবং কুমিল্লা বোর্ডে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ পয়েন্ট।

এছাড়া যশোর বোর্ডে কমেছে ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ পয়েন্ট, চট্টগ্রামে ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ পয়েন্ট, বরিশালে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ পয়েন্ট এবং দিনাজপুর বোর্ডে ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ পয়েন্ট।

গত ছয় বছরের পাসের হারের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৯ সালে ৬৭ দশমিক ৪১ শতাংশ, ২০১০ সালে ৭৮ দশমিক ১৯ শতাংশ, ২০১১ সালে ৮২ দশমিক ১৬ শতাংশ, ২০১২ সালে ৮৬ দশমিক ৩২ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৮৯ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৯২ দশমিক ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিল।

ফল ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী

পাসের হার কমার জন্য বিএনপি জোটের হরতাল-অবরোধকে দায়ী করে প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গেও একমত অনেক শিক্ষক।

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এবারের এসএসসির সবগুলো পরীক্ষার সূচি পাল্টাতে হয়। শুক্র ও শনিবার নেওয়া হয় পরীক্ষাগুলো।

সার্বিক ফলাফলে সারা দেশে দ্বিতীয় স্থানে থাকা রাজধানীর রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. ইমামুল হুদা শিক্ষার্থীদের এই সমস্যার দিকটি তুলে ধরেন।

“১৫-১৬ বছর বয়সী এক-একটা বাচ্চা, এই বাচ্চারা দুই মাস ধরে পরীক্ষা দিয়েছে। যেখানে এক মাসে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। এতদিন ধরে পরীক্ষা দেওয়ার ধৈর্য অনেক বাচ্চার মধ্যে থাকে না,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন তিনি।