শামসুল হক স্কুলের উন্নতির পূর্ণতা

রাজধানীর প্রান্তসীমার যে বিদ্যালয়টিতে বর্ষায় জলকাদা ডিঙিয়ে শিক্ষার্থীদের ঢুকতে হয়, সেই শামসুল হক খান স্কুল ও কলেজ এবার এসএসসিতে দেশসেরার আসনে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 May 2015, 04:20 PM
Updated : 31 May 2015, 02:24 PM

সার্বিক ফলাফলে রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল ও কলেজকে হটিয়ে এবার প্রথম বারের মতো শীর্ষে উঠে এসেছে ডেমরার স্কুলটি; যার প্রধান শিক্ষক বলছেন, এটা তাদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার পূর্ণতা।   

শনিবার প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসিতে অংশ নেওয়া এই বিদ্যালয়ের ৭৭৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭৪০ জনই জিপিএ-৫ পেয়েছে।

সার্বিক মূল্যায়নে ৯৭ দশমিক ৮৮ পয়েন্ট পেয়ে প্রথমবারের মতো সেরাদের সেরা হয়েছে সামসুল হক খান স্কুল ও কলেজ।

নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিয়মিত পরীক্ষার্থীর শতকরা হার, শতকরা পাসের হার, মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ও প্রতিষ্ঠানের গড় জিপিএ- এই পাঁচটি সূচক মূল্যায়ন করে সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে শিক্ষা বোর্ডগুলো।

আগের বছর ঢাকা বোর্ডে সেরা হওয়া রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবার ৯৬ দশমিক ৬৭ পয়েন্ট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এই স্কুল থেকে ৫৪৬ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে ৫৪৪ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪৯৬ জন।

সেরাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান পাওয়ার কৃতিত্ব শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক মাহবুবুর রহমান মোল্লা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শিক্ষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে গত কয়েক বছর ধরে তাদের প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাচ্ছিল। উন্নতির সেই ধারা এবার পূর্ণতা পেল। অভূতপূর্ব এই সাফল্য ধরে রাখাই তাদের আগামী দিনে চ্যালেঞ্জ।

যাত্রাবাড়ী থেকে ডেমরা সড়ক হয়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে সামসুল হক খান স্কুল ও কলেজ শহরের আধুনিক অবকাঠামো সুবিধার বাইরে। ইট ও কাঁচা মাটির তৈরি স্কুলমুখী সড়কগুলো সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধ ও কর্দমাক্ত হয়ে উঠে।

উন্মুক্ত পয়ঃনিষ্কাশন নালার দুর্গন্ধ, আশপাশের ছোট ছোট কারখানাগুলোর শব্দদূষণসহ অন্যান্য প্রতিকূলতার বিপরীতেই সেরা হয়ে উঠার পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

দেশসেরা হওয়ার পর সাংবাদিকদের কাছে উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি সড়কের সমস্যার বিষয়টিও তুলে ধরেন প্রধান শিক্ষক।

“বর্ষাকালে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে দুর্দশা নেমে আসে। সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে যায়। জ্যামে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী বিলম্বে ক্লাসে আসে।”

“রাস্তাঘাটের দুরবস্থা পাঠদানের অন্যতম বাধা। জনপ্রতিনিধিদের বারবার বলেও এই সমস্যাটির সমাধান করা যায়নি,” বলেন তিনি। 

মাহবুবুর রহমান বলেন, ২০১২ সালে এইচএসসিতে দ্বিতীয় স্থান পাওয়ার পরই তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। তখন থেকে আরও ভালো কিছু করার প্রচেষ্টা শুরু হয়।

শিক্ষার্থীরা জানায়, দশম শ্রেণির ক্লাস শুরুর পর থেকেই স্কুলের বাইরে প্রাইভেট টিউশনি নিষিদ্ধ করে শিক্ষকরা পড়াশোনার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেন। নিয়মিত ক্লাসের বাইরে শিক্ষকরা বিশেষ কোচিং ক্লাস চালু করেন, যা সাফল্যের পেছনে ভূমিকা রাখে।

প্রধান শিক্ষক বলেন, একজন শিক্ষককে ১৫ জন করে পরীক্ষার্থীর দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া প্রতিটি বিষয়ের জন্য বিশেষ কোচিং ক্লাস নেওয়া হয়েছিল। এসব কিছুর বাইরে অন্য কোথাও শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়া ছিল নিষিদ্ধ।

“আর এসব কাজে অভিভাবক, শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির ঐকান্তিক সহযোগিতা ছিল,” সাফল্যের পথ তুলে ধরেন তিনি।

চতুর্থ শ্রেণি থেকে এই বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত হিমেল এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা, বিশেষ পাঠদান পদ্ধতি, পরিচালকমণ্ডলীর সিরিয়াসনেস ছিল। আমাদের সাফল্যের পেছনে তাদের যে শতভাগ অবদান রয়েছে একথা বলতে দ্বিধা নেই।”

শিক্ষাজীবনের প্রথম বোর্ড পরীক্ষায় সাফল্য পাওয়া তরুণ-তরুণীরাও ডাক-ঢোলের তালে তালে স্কুলের মাঠে হাসি-আনন্দে মেতে উঠে। অনেক অভিভাবককেও তাদের সদ্য এসএসসি পাস করা সন্তানদের নিয়ে স্কুলের মাঠে ভিড় করতে দেখা যায়।

এ স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগের ৪১৭ পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪১৫ জন, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৩০১ পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৯৩ জন, মানবিকে ৬১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩২ জন। ছেলে পরীক্ষার্থী ৪১০ আর মেয়ে পরীক্ষার্থী ৩৬৯ জন।

তবে এসএসসির এবারের ফলাফলে ডেমরার শামসুল হক খান স্কুল ও কলেজের চমক দেখিয়ে দেশসেরা হওয়া নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে।

কয়েকটি স্কুলে এমসিকিউ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র শিক্ষকদের যোগসাজশে হলের বাইরে যাওয়ার প্রমাণ মিলেছে বলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ফল ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেন।

শামসুল হক স্কুলের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না- জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “অনেকেই সন্দেহের তালিকায় আছে। আপাত দৃষ্টিতে তারা ফার্স্ট হয়েছে বলেই ধরে নিচ্ছি। যেহেতু আপনারা প্রশ্ন তুলেছেন, আমরা খোঁজ নেব।”