অর্জনের উচ্ছ্বাসেও ভেজাচোখ

কারও চোখেমুখে ছিল উচ্ছ্বাস, কেউবা ভেজা চোখ। এসএসসির ফল প্রকাশের পর অর্জন-ব্যর্থতায় এমন দৃশ্যের দেখা মিলেছে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 May 2015, 03:17 PM
Updated : 30 May 2015, 03:39 PM

এসএসসিতে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া হাজারো উচ্ছ্বসিত মুখের অর্জন ছুঁয়ে গেছে অভিভাবকদেরও।   

শনিবার দুপুরের পর স্কুলগুলোতে টানিয়ে দেওয়া হয় ফল। এরপর থেকেই শুরু হয় আনন্দের উদযাপন, যাতে সামিল হয়েছিলেন তাদের বাবা, মা ও স্বজনরা।

রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী তাশদিয়া আলম তিশার কথা বলতে গিয়ে তার বাবা গাজী মো. শাহ আলম যেমন বললেন ছয় বছর আগে মেয়েকে ভর্তির কথা।

তিনি বললেন, “ও কেবলই বলছিল, বাবা আমি যদি এই স্কুলে ভর্তি হতে না পারি, তাহলে আমি আর পড়ব না। আমার সে বছরই এখানে ভর্তি হয়। প্রতি ক্লাসে প্রথম হয়।

“গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে সে তার একাগ্রতার ধারাবাহিকতার প্রমাণ দিল।”

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পড়াশোনার ব্যাপারে আমরা কিন্তু ওকে খুব একটা কেয়ার নেই না। ও নিজেই বেশি সচেতন। নিজের আগ্রহে পড়াশোনা করে।

“সাইন্স থেকে পাস করেছে। আমি চেয়েছি, ও অন্য কিছু হোক। কিন্তু ও চায়, বার অ্যাট ল করবে। আইনজীবী হবে। আমি বলেছি ঠিক আছে।”

ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সময় রাজউকের প্রতি এত দুর্বলতা কেন ছিল- জানতে চাইলে তিশা বলেন, “রাজউক ভালো স্কুল এটা জানতাম। তবে একমাত্র পছন্দের জায়গায় কেন গিয়েছে, সেটা জানি না। অবচেতন মনে এটা হয়েছে।”

তিশার বাবার সঙ্গে কথা বলার সময় সে ব্যস্ত ছিল গোল্ডেন না পাওয়া তার এক বান্ধবীকে সান্ত্বনা দিতে।

বিজ্ঞান থেকে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া মির্জা নুসরাত জাহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরীক্ষায় অনেক ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু আত্মবিশ্বাস হারাইনি। তাই শেষ পর্যন্ত ফল অনেক ভালো হয়েছে। শুধু আমি নই, আমার সব বন্ধুরা গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে।”

সব বান্ধবী মিলে ভালো ফল করায় আনন্দ দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানান নুসরাতের বান্ধবী তামান্না সাবরিন তমা।

বিজ্ঞান থেকে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া তাহমিদ ওয়ারা উচ্ছ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকাল থেকে খুব টেনশন হচ্ছিলো। ১১টার দিকে আসলাম। ফল পাওয়ার পর মন ভালো হয়ে গেল।”

উচ্ছ্বাসের বাবা বেপজার প্রকৌশলী রফিকুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন্তানের অর্জনের চেয়ে বড় আনন্দ আর কি হতে পারে? নিঃসন্দেহে অনেক ভালো লাগছে।”

ফলের দিন সকাল থেকে অস্থিরতার কথা জানান একই স্কুলের বাণিজ্য থেকে গোল্ডেন পাওয়া নাফিস ইমতিয়াজ কৌশিক।

তিনি বলেন, “সকাল থেকে খুব অস্থির লাগছিল। এসে ফল পেয়ে ভালো লাগছে।”

শনিবার ফল পেয়ে উচ্ছ্বসিত মুখ যেমন দেখা গেছে, দেখা গেছে প্রত্যাশিত ফল না পেয়ে অশ্রুসজল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদেরও।

এদেরই একজন আফরোজা বেগম। ২০০৩ সালে সরকারি কর্মকর্তা আফরোজার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। একমাত্র সন্তান মো. তাসনীম সিফাত তখন নিতান্তেই কোলের শিশু।

স্বামীকে হারানোর পর দিশেহারা এই মা দ্রুত তার শিশু সন্তানকে বুকে আঁকড়ে সামনের দিকে তাকানো শুরু করলেন। সন্তানকে মানুষের মত মানুষ করতে পাড়ি দেন জীবনের কঠিন পথ। তিল তিল করে ছেলেকে নিয়ে আসেন এসএসসি পর্যন্ত।

ছেলেকে যতটুকু জানেন-চেনেন, তাতে আশা ছিল- গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ার মাধ্যমে ছেলে জীবনের এই ধাপ ভালোভাবেই উতরে যাবে।

তবে তা না হওয়ায় নিজেকে অপরাধী মনে করছেন সংগ্রামী এই মা। ফল প্রকাশের পর রাজউক উত্তরা মডেল স্কুলের ভেতরে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাকে।

মন খারাপের কারণ জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভারি গলায় বললেন, “দেখেন, একা মানুষ। ওকে নিয়ে জীবন পাড়ি দিয়েছি। ওইতো আমার একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু ওর বন্ধুরা যখন গোল্ডেন পেলো, তখন ওর এই ফলে আমার মন খারাপ লাগছে।”

“মনে হচ্ছে, এটা আমার জন্যই হয়নি। আমি যদি ওকে আরেকটু সময় দিতাম। যদি আরেকটু ভালোভাবে তত্ত্বাবধান করতে পারতাম। তাহলে হয়তো আজ এরকম হতো না। আর ও গোল্ডেন পাওয়া অনেকের চেয়েও ভালো। এজন্য আরও মন খারাপ হচ্ছে। পরীক্ষার সময় তিন মাস অর্জিত ছুটি নিয়েছিলাম। কিন্তু তাও হলো না।”

ছোট বেলায় ও মাইলস্টনে পড়েছে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে রাজউকে ভর্তি হয়েছে তাসনীম।

তাসনীমের মা বলেন, “এখানে ভর্তি পরীক্ষায় ও ১০ হয়েছিল। পরেও এর ধারাবাহিকতা ছিল।”

তবে তাসনীমের প্রতিক্রিয়া কিছুটা ভিন্ন, যা তার ভাষায় ‘মিশ্র অনুভূতি’।

তিনি বলেন, “গোল্ডেন না পাওয়ায় মন খারাপ, কলেজ দ্বিতীয় হওয়ায় মন খারাপ। এত উত্থান পতনের পরীক্ষায়ও এ প্লাস পাওয়া বেশ ভালো লাগছে।”

নিজের কাঙ্ক্ষিত ফল না হওয়ার জন্য পরীক্ষার সূচিতে ঘনঘন পরিবর্তনকে দায়ী করেন এই শিক্ষার্থী।

রিয়েল স্টেট ব্যবসায়ীর স্ত্রী লুৎফুন নাহারের দুঃখটা অবশ্য রকম। দুই সন্তানকে মানুষ করতে কর্মজীবী না হয়ে গৃহিনী থেকে গিয়েছেন তিনি। রাজউক থেকে এবার এসএসসি উত্তীর্ণ আহমেদ বখতিয়ার নাবিল তার বড় সন্তান।

বাণিজ্য থেকে এ প্লাস পাওয়া বখতিয়ার বলেন, “এত দীর্ঘ পরীক্ষা। মনে করেছিলাম, কম্পিউটারে মিস হবে। কিন্তু মিস হলো বাংলায়। গোল্ডেন না পাওয়ায় মন খারাপ হচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে ভালো করতে হবে।”

লুৎফুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার ছেলে সব সময় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। ছেলেদের জন্য পুরো সময় দেওয়ার বিষয়টা আমি উপভোগ করতাম। মনে হতো, আমার ছেলে ভালো করছে। কিন্তু আজ গোল্ডেন না পাওয়ায় কিছুটা মন খারাপ।”

দক্ষিণখানের ইমারত হোসেন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের কারিগরি বিভাগ থেকে ৪ দশমিক ৫ পেয়ে এবার এসএসসি উত্তীর্ণ শহিদুল ইসলাম সজল।

উত্তরার একটি রডের দোকানের ম্যানেজারের সন্তান সজলের স্বপ্ন ছিল ঢাকা পলিটেকনিক থেকে ইলেকট্রনিক্সে ডিপ্লোমা করার। গড়পড়তা হিসাবে এর জন্য তার দরকার ছিলো এ প্লাস। কাঙ্ক্ষিত সেই ফল না পাওয়ায় এখন মন খারাপ সজলের।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “লড়াইটা একটু কঠিন হয়ে গেলে। এই ফল হওয়ায় হয়তো অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হবে।

“হরতাল অবরোধের কারণে বারবার তারিখ পরিবর্তন হয়েছে। তাই হয়তো ফল খারাপ হয়ে গেছে।”

নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ৪ দশমিক ৮১ পয়েন্ট পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে আলমগীর হোসেন ফাহিম। আত্মীয় স্বজনের অনেকে গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গে থাকায় সে ভবিষ্যতে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়।

কিন্তু পরীক্ষার সূচি নিয়ে নানা ধরনের ঝামেলার কারণে তার এই ফল বিপর্যয় বলে তিনি জানান।

তিনি বলেন, “একটা অনিশ্চয়তা নিয়ে পুরো পরীক্ষা দিতে হয়েছে। কখন পরীক্ষা হবে-এটা নিশ্চিতভাবে না জানায় কঠিন বিষয়গুলোতে বেশি সময় দিয়েছি। ফলে সহজ বিষয়গুলোতেই খারাপ হয়েছে। এই জন্যই আরো বেশি মন খারাপ হচ্ছে। চেয়েছি গোল্ডেন এ প্লাস, কিন্তু পেলাম কি?”