ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিক প্রবেশে এবার ইসির ‘কড়াকড়ি’

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাংবাদিকদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা ও নাজেহালের ঘটনার পর এবার স্বয়ং নির্বাচন কমিশনই ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রবেশে ‘কড়াকড়ি’ আরোপ করতে যাচ্ছে।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 May 2015, 04:36 PM
Updated : 29 May 2015, 04:36 PM

একসঙ্গে ‘অনেক’ সাংবাদিক ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করলে কাজে ‘বিঘ্ন’ ঘটে এমন অজুহাতে একসঙ্গে পাঁচ জন সাংবাদিক প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ।

৩০ মে মাগুরা-১ উপ নির্বাচন সামনে রেখে দেওয়া এ নির্দেশনা আগামীতে সব নির্বাচনেই অনুসরণ করবে ইসি।

বৃহস্পতিবার মাগুরা উপ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে সাংবাদিকদের বিষয়ে ইসির ৯ দফা নির্দেশনা পাঠিয়েছে জনসংযোগ শাখা।

এতে বলা হয়েছে, একসঙ্গে ৫ জনের বেশি সাংবাদিক কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবে না; দশ মিনিটের বেশি সময় কেন্দ্রে অবস্থান করতে পারবে না।

‘শৃঙ্খলা’ আনতে এ ধরনের তৎপরতায় সাধারণ মানুষের মধ্যে অনাস্থা তৈরি হতে পারে বলে মত দিয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন।

এক মাস আগে ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩০টিরও বেশি কেন্দ্রে অনুমোদিত সাংবাদিকদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেওয়া ও নাজেহালের ঘটনা ঘটে। প্রকৃত বিষয় উদঘাটনে জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও ইসি কর্মকর্তার সমন্বয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তদন্ত কমিটিও করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট শতাধিক ব্যক্তির বক্তব্য নিচ্ছে তদন্ত কমিটি। এখনো শুনানি শেষ হয় নি। ২ জুন সাংবাদিকদের শুনানি রয়েছে। কমিটি প্রকৃত ঘটনা ও সুপারিশসহ ইসিতে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে।

তিন সিটি নির্বাচনের পর মাগুরা-১ উপ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ২১ মে আইন শৃঙ্খলা বৈঠক করে ইসি। সাংবাদিকদের বাধা ও নাজেহালের বিষয়টি উঠে আসে।

এ বৈঠকের কার‌্যবিবরণীতে নির্বাচন কমিশন ও বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বক্তব্য লিখিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এর অনুলিপি সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়।

বাধা নয়, ঝাঁক ধরে না ঢুকে দল করে যাবে

মাগুরা-১ উপ নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, “ইসি ও আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর কার‌্যক্রমে স্বচ্ছতা দৃশ্যমান রাখতে সাংবাদিকদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। সাংবাদিকরা ভোটকেন্দ্রে যাবেন এবং কেন্দ্রে তাদের প্রবেশে কোনো বাধা দেওয়া যাবে না। প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহের স্বার্থে তারা কেন্দ্রে প্রবেশ করবেন।”

সভায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এক প্রতিনিধি বলেন, “সাংবাদিকরা অনেক সময় ভোটগ্রহণ কার‌্যক্রম বাধাগ্রস্ত করেন। অনুরোধ করা হলেও তারা সহযোগিতা করেন না। এ বিষয়ে স্থানীয় পর‌্যায়ে একটি সভা করে তদের সহযোগিতা কামনা করা যতে পারে।”

যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী সাংবাদিকদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ।

নির্বাচন কমিশনার জাবেদ আলী জানান, সাংবাদিকদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের বিষয়ে তিন সিটিতে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এ সমস্যা সমাধানে সাংবাদিকদের ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনের করানোর মতামত দেন তিনি।

ব্রিটেনের উদাহারণ টেনে নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, “সেখানে সাংবাদিকসহ অন্যান্য পর্যবেক্ষকরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে নির্বাচনী কাযক্রম পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। এখানেও নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানসাপেক্ষে সাংবাদিকদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।”

নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক মত দেন, নির্বাচনী কাজে যুক্ত নন এর রকম কতজন ব্যক্তি একসঙ্গে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন এবং সেখানে কতক্ষণ অবস্থান করতে পারবেন সে বিষয়ে একটা নীতিমালা হওয়া প্রয়োজন।

সবশেষে সিইসি কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ জানান, অনেক ভোটকেন্দ্রের ভোটকক্ষগুলোতে জায়গার সংকট থাকে। সেক্ষেত্রে একসঙ্গে অনেক সাংবাদিক ভোটকেন্দ্রের ভেতর প্রবেশ করলে ভোটগ্রহণ বিঘ্নিত হতে পারে।

“এজন্যে সাংবাদিকদের ৫/৬ জনের একটি দল করে পর‌্যায়ক্রমে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। একটি দল পরিদর্শন শেষে বের হয়ে আসার পর অন্য একটি দলকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।”

কার্ডে যা থাকে

ভোটের দিন পেশাগত দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং কর্মকর্তার কার‌্যালয় থেকে সাংবাদিক কার্ড সরবরাহ করা হয়। সাংবাদিক পরিচয়পত্রের অপর পৃষ্টার নির্দেশাবলীতে লেখা রয়েছে- এ অনুমতিপত্র হস্তান্তরযোগ্য নয়; কার্ডের বাহক ভোটদানের গোপনকক্ষে প্রবেশ করবেন না; ভোটকেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসারের নির্দেশ মেনে চলবেন এবং বাহক পর‌্যবেক্ষণ নীতিমালা ও কোড অব কন্ডাক্ট মেনে চলবেন।

মাগুরায় ইসির নির্দেশনা

মাগুরা-১ উপ নির্বাচনে স্থানীয় সাংবাদিক অনুমোদন ও পরিচয়পত্র দিতে ইসির জনসংযোগ শাখার থেকে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়ে তা মেনে চলার বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্যে জন্য বলা হয়েছে।

রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের আগে প্রিজাইডিং কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবে না; ভোটকেন্দ্রে পাঁচ জনের বেশি সাংবাদিক প্রবেশ করতে পারবে না। ১০ মিনিটের বিশি অবস্থান করা যাবে না, ভোটকক্ষে নির্বাচনী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা যাবে না…কার্ডের উল্টোপিঠে লিখিত নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।

ইসির জনসংযোগ পরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান জানান, সাংবাদিকরাও বিদ্যমান পর‌্যবেক্ষণ নীতিমালা মেনেই ভোটে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। আগেও তা-ই ছিল। কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবার শুধু বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু এ নীতিমালা শুধু পর‌্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর জন্যে প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পর‌্যবেক্ষণ সংস্থা প্রতি দলে ৫ জন করে একাধিক ভ্রাম্যমান দল রাখবে। ভোট কক্ষে স্বল্প সময়ের জন্য অবস্থান ও কার‌্যক্রম পর‌্যবেক্ষণ করবে। বুথভিত্তিক সার্বক্ষণিক পর‌্যবেক্ষণ করা যাবে না।

জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাধারণত সাংবাদিকরা ভোটের কাজে কখনো বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করে না। সরাসরি প্রোগ্রামের প্রতিযোগিতায় এখন অনেক সাংবাদিক হয়ত কেন্দ্রে একসঙ্গে থাকছে, কিন্তু ভোটকক্ষে তো একসঙ্গে এতো লোক যায় না।

তবে নির্বাচন কমিশ হয়ত কাজের সুবিধার্থে উদ্যোগ নিতে পারে বলে মত দেন তিনি।

সাবেক এ কমিশনার বলেন, “ভোটকক্ষে শৃঙ্খলা রাখতে সাংবাদিকদের বিষয়ে কড়াকড়ি করলেও মনে রাখতে হবে এ নিয়ে যেন জনগণের মধ্যে অনাস্থা তৈরি না হয়। সাংবাদিকরা নিজেরাই ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের বিষয়টি ম্যানেজ করতে পারে। ইসি হঠাৎ নির্দেশনা দিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে।”