ভুল খবরে পিষ্ট এক হামিদার জীবন

নয় মাসের সন্তান থাকার পরও আরেকটি ‘সন্তান প্রসবের’ ভুল খবর প্রকাশিত হওয়া নিয়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে সমাজে সম্মানহানির আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন হামিদা ও তার পরিবার।

রিয়াজুল বাশার গাজীপুর থেকে ফিরেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 May 2015, 03:53 AM
Updated : 30 May 2015, 11:18 AM

বুধবার দুপুরে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বিশ্বাসপাড়ায় হামিদা আক্তারের ভাইয়ের ভাড়া বাড়িতে কথা হল তাদের সঙ্গে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার দরিদ্র পিতা-মাতার পাঁচ সন্তানের ছোট হামিদার চোখে-মুখে চিন্তা ও আতঙ্কের ছাপ।

পত্রিকায় ভুল খবর প্রকাশ, তা আদালতে গড়ানো; সবকিছুরই কেন্দ্রবিন্দু হামিদা। নয় মাসের সন্তানের পরও আরেকটি ‘সন্তান প্রসব’; তা নিয়ে পাড়া পড়শীর ‘ভিন্ন কিছু ভাবা’- এ নিয়ে চিন্তার শেষ নেই হামিদার পরিবারের।  

হামিদার ভাই লাল মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের খুব ক্ষতি করে ফেলেছে। বাড়িয়ে বাড়িয়ে লিখেছে।”

“এই যে প্রচার হয়েছে, সেটা দেখে দেশের মানুষ নানা কথা বলছে। এটা ইজ্জতের সমস্যা না?” প্রশ্ন করেন দিনমজুর লাল মিয়া।

হামিদা আক্তারের অপরিণত গর্ভপাতকে ‘সন্তান প্রসব’ উল্লেখ করে দৈনিক প্রথম আলো সংবাদ প্রকাশ করলে তা দেখে গত ১০ মে উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিষয়টি তদন্ত করতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছিল, তলব করা হয়েছিল কারখানার কর্মকর্তাদের।

নির্দেশ পেয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তদন্ত করে এপেক্স ফুটওয়্যার কারখানায় ওই ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন।   

ভুল সংবাদ প্রকাশ করায় হামিদা আক্তারকে এক লাখ টাকা দিতে প্রথম আলোকে নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত।

কর্মস্থলের পাশেই বিশ্বাসপাড়ায় হামিদাদের বাসাতেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা হয় তাদের।  

সাংবাদিক পরিচয় শুনেই প্রথমেই যেন একটু ধাক্কা খান ২৩ বছর বয়সী রাজমিস্ত্রি লাল মিয়া। কথা শুরুই করলেন তার বোনের ঘটনায় সংবাদপত্রগুলোর ভূমিকার সমালোচনা করে।

“আমরা বিচার চেয়েছিলাম। বিচার পেয়েছি।”

কীসের বিচার- জানতে চাওয়া হলে লাল মিয়া বোঝালেন, তাদের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার হয়েছে তার বিচার। আদালত যে প্রথম আলোকে এক লাখ টাকা দিতে বলেছে, সেটাকেই বিচার পাওয়া হিসেবে ভাবছেন লাল মিয়া।

তারপরও লাল মিয়ার চিন্তা, “ভুল প্রতিবেদন হওয়ায় যেটা হয়নি, সেটা এখন অনেক মানুষ বলবে।”

হামিদার পরিবার মিডিয়ার ভূমিকায় এতটাই ক্ষেপেছেন যে, মিডিয়া ‘বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে’ উল্লেখ করে পরদিন থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।

হামিদাকে নিয়ে গত ১০ মে দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘ছুটি মেলেনি, কারখানার টয়লেটে সন্তান প্রসব’।

মা দিবসে নারী শ্রমিককে নিয়ে ওই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।

প্রতিবেদনটি দেখে সেদিনই আদালত আদেশ দিলে ১৩ মে প্রথম আলো ভুল স্বীকার করে জানায়- “প্রকৃতপক্ষে কারখানার ওই নারী কর্মী ছুটি চাননি। তিনি সন্তান প্রসব করেননি, গর্ভপাত ঘটেছিল।”

কারো নামোল্লেখ না করে কারখানা শ্রমিক ও কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, কর্তৃপক্ষ ছুটি না দেওয়ায় ওই নারী শ্রমিক কারখানার টয়লেটে সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তা ছিল না।

হামিদার গর্ভপাতের পরপরই শফিপুরের খাজা বদরুদ্দোজা মডার্ণ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।

সেখানকার সহকারী ব্যবস্থাপক সুমন দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আলট্রাসনো প্রতিবেদনে দেখা গেছে, হামিদা আক্তারের ১৬ সপ্তাহের অপরিণত গর্ভপাত ঘটেছে। এটাকে কোনভাবেই সন্তান প্রসব বলা যায় না।”

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ভিকটিম, তার পরিবারের কারও কিংবা হাসপাতালের কারও বক্তব্য নেওয়া হয়নি।

লাল মিয়া বলেন, “এই রিপোর্ট করার আগে আমাদের সঙ্গে কথা বলা উচিৎ ছিল। আমরা গরিব মানুষ, কাজ করে খাই। আমাদের নিয়ে বাড়াবাড়ি লিখে মানুষের কাছে ছোট করার মানে আছে?”

ভুল প্রতিবেদনের জন্য প্রথম আলোর অর্থ গোনার ঘটনা এবার প্রথম হলেও এর আগে একাধিকবার ভুল প্রতিবেদন করে তা নিয়ে হৈচৈ শুরু হলে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে মাফ চাওয়া হয়েছে। তিরস্কারও শুনতে হয়েছে আদালতের।

গত বছরই আদালত অবমাননার জন্য সংবাদপত্রটি দোষী সাব্যস্ত হলে ক্ষমা চেয়ে রেহাই নিয়েছিলেন এর সম্পাদক মতিউর রহমান। তবে শাস্তি পেতে হয় প্রথম আলোর সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানকে।

এর আগে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একটি কার্টুন প্রকাশ নিয়ে সমালোচনার মুখে বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিবের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন মতিউর রহমান। তখন প্রদায়ক কার্টুনিস্টের পাশে না দাঁড়ানোর জন্যও প্রথম আলোর সমালোচনা হয়।

প্রায় ঘণ্টাব্যাপী কথা বলার সময় কখনোই হামিদার মুখে হাসি দেখা যায়নি। এক পর্যায়ে হামিদা বললেন, তার চাওয়া একটাই। মানুষ যেন তাকে ‘ডিস্টার্ব’ না করে।

গণমাধ্যমের ভুল খবর মানুষের ব্যক্তিজীবনে অনেক সময় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, এমন অনেক গবেষণা রয়েছে।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মিডিয়ার একটাই দায়িত্ব, যে সংবাদটা তারা প্রকাশ করছে বা প্রচার করছে, সেটা সঠিক তথ্য কি না। বস্তুনিষ্ঠভাবে সেটা প্রকাশ হচ্ছে কি না। সেটা দেখা দরকার।

“অতএব সেখানে চেক করা, ক্রস চেক করা গণমাধ্যমের দায়িত্ব। সেটা করা হলে এ ধরনের ভুল হওয়ার কথা না।”

সাংবাদিকতার মৌলিক যে নিয়মকানুন-বিধিবিধান অনুসরণ করলে সহজেই এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“তারপরও যদি ভুলভ্রান্তি হয়ে যায় সেটা পত্রিকা কর্তৃপক্ষ সংশোধনী ছেপে সংশোধন করার চেষ্টা করে। আমার মনে হয়, এসব বিষয়ে আরও সতর্ক থাকার দরকার।”

[সাভার প্রতিনিধি সেলিম আহমেদ প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন। ছবি তুলেছেন তানভীর আহমেদ।]