ভোট ছাড়াই ‘সমঝোতার’ কমিটি জাতীয় প্রেস ক্লাবে

নির্বাচন নিয়ে জটিলতার মধ্যে ডাকা এক সভায় ভোট ছাড়াই একটি কমিটি হয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাবে, তবে বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটির কর্মকর্তারা এই সভায় ছিলেন না।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 May 2015, 10:18 AM
Updated : 6 August 2015, 02:32 PM

জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রবীণ সদস্য ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শাহজাহান মিয়ার সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার এই সাধারণ সভায় ক্লাবের প্রায় এক হাজার সদস্যের মধ্যে শতাধিক জন উপস্থিত ছিলেন। অনেকে সভায় ছিলেন, যারা প্রেস ক্লাবের সদস্য নন।

নতুন কমিটিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াত সমর্থক সাংবাদিক ইউনিয়নের উভয় অংশের নেতারা রয়েছেন। সভায়ও বিএনপি সমর্থক সাংবাদিকদের একাংশ উপস্থিত ছিল।

সভায় সর্বসম্মতভাবে গঠিত কমিটিতে সভাপতি করা হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থক মুহাম্মদ শফিকুর রহমানকে, সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে বিএনপি সমর্থক কামরুল ইসলাম চৌধুরীকে।

১৭ সদস্যের এই কমিটিতে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি করা হয়েছে মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলকে। আমিরুল ইসলাম কাগজী সহসভাপতি, কার্তিক চ্যাটার্জি কোষাধ্যক্ষ, আশরাফ আলী ও ইলিয়াস খান যুগ্ম সম্পাদক হয়েছেন।

কার্যনির্বাহী সদস্য থাকছেন আমানুল্লাহ কবীর, খন্দকার মনিরুল আলম, আজিজুল ইসলাম ভুঁইয়া, সাইফুল আলম, শ্যামল দত্ত, শামসুদ্দিন আহমেদ চারু, মোল্লা জালাল, সর্দার ফরিদ আহমেদ, হাসান আরেফীন ও শামসুল হক দুররানী।

দুপুরে প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সভায় নতুন এই কমিটির ঘোষণা দেন বিএনপি সমর্থিত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এলাহী নেওয়াজ খান সাজু।

সভায় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী, আমানুল্লাহ কবীর, গোলাম সারওয়ার, হাসান শাহরিয়ার, খন্দকার মনিরুল আলম, আবুল কালাম আজাদ, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, আলতাফ মাহমুদ, কাজী সিরাজ, এলাহী নেওয়াজ খান সাজু, আবদুল জলিল ভুঁইয়া, কুদ্দুস আফ্রাদ।

সকাল সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়া এই সাধারণ সভার কথা জানতেন না বলে অনেক সদস্য অভিযোগ করেছেন।

বিএনপি সমর্থিত ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বর্তমান কমিটির শীর্ষ নেতাদের কেউ সভায় ছিলেন না। প্রেস ক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটির বর্তমান সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদও ছিলেন না সভায়।

নতুন কমিটির প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি সমর্থিত প্যানেল থেকে নির্বাচিত গত মেয়াদের প্রেস ক্লাব নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদাল এক বিবৃতিতে বলেছেন, এটা ‘অবৈধ’ কমিটি।

“ক্লাবের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেবল নির্বাচনের মাধ্যমেই এক কমিটির কাছ থেকে আরেক কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রথা। কাজেই দ্বি-বার্ষিক সাধারণ সভার নামে যারা তথাকথিত একটি সভা করেছেন, তা গঠনতন্ত্রের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ক্লাবের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিপন্থি।”

গত কয়েকদিন ধরে ক্লাবের নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার মধ্যে ক্লাবের সাধারণ সদস্যদের উদ্যোগে এই সাধারণ সভা হয়েছে বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন।

সাধারণ সভায় ক্লাব প্রাঙ্গণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি স্থাপন এবং বিগত কমিটির দুর্নীতি-অনিয়ম তদন্ত করে শ্বেতপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয় বলে জানানো হয়েছে।

একই সঙ্গে ক্লাবের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে সদস্য সংখ্যা এক হাজার থেকে দেড় হাজারে উন্নীত করার প্রস্তাবও পাস হয়।

বতর্মান নেতৃত্বকে চলে যাওয়ার আহ্বান

সভায় আওয়ামী লীগ সমর্থক সাংবাদিকদের নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, “কয়েক বছর ধরে জাতীয় প্রেস ক্লাব একটি গোষ্ঠি ও রাজনৈতিক দলের আখড়ায় পরিণত হয়েছে, এভাবে ক্লাব চলতে পারে না।

“আমি স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, আমরা দেশে স্বেচ্ছাচারিতা মানি নাই, জাতীয় প্রেস ক্লাবেও কোনো স্বেচ্ছাচারিতা আর মেনে নেওয়া হবে না।”

মেয়াদোত্তীর্ণ বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটিকে ‘অবৈধ’ আখ্যায়িত করে ইকবাল সোবহান বলেন, “৩১ মার্চের পর থেকে এই কমিটির ক্লাব পরিচালনার কোনো আইনগত বৈধতা নেই। অতিরিক্ত সাধারণ সভায় ৩১ মার্চের মধ্যে সাধারণ সভা ও নির্বাচনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তারপরও তারা চেয়ার আঁকড়ে রেখেছেন।

“আমরা সাধারণ সদস্যরা এর জবাবে বলতে চাই, আপনারা অবৈধ, আপনারা আর ক্ষমতায় নেই। এরপরও যদি আপনারা ক্লাবের চেয়ার আঁকড়ে থাকেন, তাহলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব। সাধারণ সদস্যরা আপনাদের মোকাবেলা করবে।”

ক্লাবের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এই সাধারণ সভা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “আজকের সভায় যারা সমবেত হয়েছেন, তারা জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে অপশক্তির হাত থেকে মুক্ত করার সংগ্রামে শামিল হলেন।”

সবার সমঝোতায় এই কমিটি গঠিত হয়েছে দাবি করে ইকবাল সোবহান বলেন, ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত ফোরামকে সভাপতি, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতিসহ ১০টি পদ এবং জাতীয়তাবাদী দল সমর্থিত ফোরামকে সাধারণ সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষসহ সাতটি পদ দেওয়া হয়েছে।

এবার নির্বাচনের তফসিল হওয়ার পর সমঝোতার একটি প্যানেল দেওয়া হয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি অংশ এবং বিএনপি সমর্থকদের একটি অংশ আলাদা প্যানেল দেয়।

পরে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ‘পরিবেশ নেই’ বলে দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করলে নির্বাচন আটকে যায়। 

ইকবাল সোবহান বলেন, “ক্লাবের অখণ্ডতা ধরে রাখতে আমরা এটা করেছিলাম। ঐক্যও হয়েছিল। কিন্তু একটি পর্যায়ে এসে একটি সহযোগী ফোরামের গোষ্ঠি ও রাজনৈতিক স্বার্থে ওই সমঝোতার ঐক্য ভেঙে দেওয়া হয়।”

সভায় বিএনপি সমর্থক সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা আমানুল্লাহ কবীর বলেন, “জাতীয় প্রেস ক্লাবকে ইউনিয়নের মতো বিভক্ত করে এর অখণ্ড ঐতিহ্যকে বিনষ্ট করায় আজকের এই সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। যদি ব্যক্তিবিশেষ এই ক্লাবের নেতৃত্ব কুক্ষিগত না করত, তাহলে এই সঙ্কট সৃষ্টি হত না বলে আমি মনে করি। আমরা সেজন্য সমঝোতার একটি প্যানেলের মাধ্যমে এই সঙ্কট থেকে উত্তরণ ঘটাতে চাই।

“কথা ছিল একটি সমঝোতা হবে। কার কারণে ওই সমঝোতা ভেঙেছে? সমঝোতা যারা ভেঙেছে, তারা আজ এই সভায় আসেননি,” বলেন অবিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নের এই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় সাংবাদিক নেতা আমানুল্লাহ কবীর বলেন, “আমরা মনে করি, দল-মত নির্বিশেষে ক্লাবকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। একে কোনো রাজনৈতিক দলের প্ল্যাটফর্ম বানানো যাবে না। এটা পেশাদার সাংবাদিকদের মানোন্নয়ন ও বিশ্রামের স্থান।”

ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মনিরুল আলম বলেন, “২০০২ সালে যে কমিটি বিজয়ী হয়ে আসে, তারাই একচেটিয়াভাবে সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে দুই ফোরামের ভোট ভারসাম্যহীন করে ফেলে। ফলে সৃষ্টি হয় সঙ্কটের। আমরা এই ভারসাম্যহীনতার অবসান চাই।”

বিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ইউনিয়ন নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান মনিরুল আলম, যিনি বিএনপি সরকারের সময়ে প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন।

সভায় বক্তব্য রাখেন ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক স্বপন সাহা, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আলতাফ মাহমুদ। সভা পরিচালনা করেন ক্লাবের সদস্য আশরাফ আলী।

সভাপতির বক্তব্যে শাহজাহান মিয়া বলেন, “আজকের এই সভা ঐতিহাসিক একটি সভা। এটা জাতীয় প্রেস ক্লাবের ইতিহাস মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।”

সভায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর ক্লাব লাউঞ্জে এসে সবার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন শফিকুর রহমান ও কামরুল ইসলাম।